ডুবল শহর, সীমাহীন দুর্ভোগ

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বৃষ্টি অলিগলি, বাসাবাড়ি, দোকানপাটে পানি ‘৩৭ বছরে এত পানি দেখিনি’দিনভর বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় ভোগান্তি

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৮ মে, ২০২৪ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ঘূর্ণিঝড় রেমালএর প্রভাবে অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে নগরে। এতে তলিয়ে যায় শহরের নিম্নাঞ্চল। বিগত সময়ে পানি উঠেনি এমন এলাকায়ও হয়েছে জলাবদ্ধতা। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে যায় বেশিরভাগ এলাকার সড়ক ও অলিগলি। পানি ঢুকে বহু বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে। পানিবন্দী হয়ে পড়ে নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ও ভোগান্তি হয়েছে পথচারীর। বিশেষ করে সকালে কর্মস্থলমুখী এবং জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া লোকজনের দুর্ভোগ ছিল অসহনীয়।

এদিকে বৃষ্টি শুরু হলে শুরু হয় বিদ্যুতের আসা যাওয়া। সকালে টানা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না মোহাম্মদপুরসহ অনেক এলাকায়। বিকেলে বিদ্যুৎ এলেও তা নিরবচ্ছিন্ন ছিল না বলে জানান শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।

গত রোববার দিবাগত মধ্যরাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। গতকাল সোমবার দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৃৃষ্টি হয়েছে এদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। এসময় ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া সকাল ৯টা ২২ মিনিটে শুরু হয় জোয়ার। ফলে বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতে একাকার হয়ে বাড়ে জলাবদ্ধতা। দুপুর ১টার পর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে পানি। অনেক নিচু এলাকায় বিকেলেও পানি ছিল।

জলাদ্ধতায় শহরের প্রধান বা মূল সড়কগুলোতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে সৃষ্টি হয় যানজট। মুরাদপুর থেকে বহাদ্দারহাটমুখী সড়কেও বেশ কিছুক্ষণ যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে পথচারীর দুর্ভোগ অরো বেড়ে যায়। এসময় রিকশাচালকদের মনগড়া ভাড়া দাবি করেন বলে অভিযোগ করেন পথচারীরা। এদিকে পানির জন্য সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকে নৌকা নামায় সড়কে। কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় নৌকা চলতে দেখা গেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএ’র মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফেরদাওছ বলেন, সকালে টানা আড়াই ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে। এতে নিচু এলাকায় পানি জমেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পানি দ্রুত নেমে গেছে। বৃষ্টির সময় পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য ১২টি টিম কাজ করেছে বলেও জানান তিনি।

বৃষ্টির পরিমাণ :

নগরে সবচেয়ে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায়। এ সময় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস ১৩২ মিলিমিটার এবং আমবাগান আবহাওয়া অফিস ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এছাড়া বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৪১ দশমিক ৪ মিলিমিটার এবং সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। আমবাগান আবহাওয়া অফিস সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড করে ২৩৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, কয়েকদিন আগে পূর্ণিমা গেছে। আর নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বেশি। এসময়ই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। অতিবৃষ্টি হচ্ছে।

৩৭ বছরে এত পানি দেখিনি’ :

নগরের পাঁচলাইশ এলাকায় ৩৭ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। গতকাল পানিতে তলিয়ে যায় তার বাসভবনের নিচ তলা। নিচের ফ্লোরে ৪ থেকে ৫ ফুট পানি উঠেছে জানিয়ে তিনি আজাদীকে বলেন, আমার ভবনটি নির্মাণ করেছি প্রায় ৩৭ বছর হয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে আজকের মত এত পানি উঠেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় পুরো পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় তলিয়ে যায় পানিতে। এ আবাসিক এলাকার উপর দিয়ে হিজরা খালের বিভিন্ন জায়গায় পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় জরাবদ্ধতা হয়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ :

সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, হালিশহর সবুজবাগ, শাপলা ও শ্যামলী আবাসিক এলাকা, জিইসি মোড়, ওয়াসা, তিন পোলের মাথা, রিয়াজুদ্দিন বাজার, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা, কাতালগঞ্জ বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, আগ্রাবাদ, চকবাজার মুহম্মদ শাহ আলী লেইন, ২নম্বর গেইট, মেহেদীবাগ, বাদুরতলা, বহাদ্দারহাট, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ষোলশহর, বাকলিয়া ডিসি রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠেছে।

গতকাল সরেজমিন পরিদর্শনকালে পথচারীরা তাদের দুর্ভোগের কথা জানান। চকবাজারের মুহম্মদ আলী শাহ লেনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ আজাদীকে বলেন, রাস্তায় প্রচুর পানি। সকালে ঘরে পানি ঢুকেছে। গতরাত সাড়ে ৯টায় তিনি বলেন, রাস্তার পানি নেমেছে। ঘরের ভেতর পানি রয়ে গেছে। বিদ্যুৎও নাই। এলাকার অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেছে।

মুরাদপুর মোহাম্মদপুর এলাকার ব্যবসায়ী জনি বলেন, মোহাম্মদপুর মাজার রোড সড়কটি আগে নিচু ছিল। পাঁচ ছয় মাস আগে উঁচু করে। যখন নিচু ছিল তখনও পানি উঠত। তবে দোকানে তেমন ঢুকত না। এখন সড়ক প্রায় দোকানের সমান। একটু বৃষ্টি হলেই দোকানে পানি ঢুকে যাচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ওই এলাকার একটি বাসার নিচ তলায় ঢুকে যাওয়া পানি সেচ মেশিন দিয়ে বের করতে দেখা গেছে।

সকালে স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলী সাংবাদিকদের বলেন, শহরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর, নাজিরপাড়া, বিবিরহাট, জিইসি, ২ নম্বর গেইট, শুলকবহর, চকবাজার, চান্দগাঁও এবং বাকলিয়া এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ভারি বর্ষণে ড্রেন উপচে পানি সড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুরাদপুর এলাকায় কিন্তু ড্রেনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নালা ভরে পানি সড়কের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ধারণক্ষমতার বেশি বৃষ্টি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সকালে মুরাদপুর ষোলশহর এলাকায় দেখা গেছে, কোনো গাড়ি চলছে না। রাস্তায় পানির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে অনেক যানবাহন। গাড়ির দীর্ঘ লাইন সেখান। এসময় প্রায় কোমর সমান পানি ঠেলে রিকশা টেনে নিচ্ছেন চালকরা। অনেকে ভ্যানগাড়িতে করেও গন্তব্যে যাচ্ছেন। পথচারীরা কেউ কেউ সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে হেঁটে মোড় পার হওয়ার চেষ্টা করছেন।

মুরাদপুর এলাকায় যানজটে আটকে থাকা ট্রাকচালক নজরুল বলেন, সকাল থেকে মুরাদপুরে সড়কের ওপর আটকে আছি। সামনে কোমর থেকে গলা সমান পানি। এত পানিতে গাড়ি নিয়ে সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। পানি কমার অপেক্ষায় আছি, কমলে সামনে যাবো।

চকবাজারে কথা হয় জরুরি কাজে বের হওয়া শাহীনের সঙ্গে। তিনি জানান, কাপাসগোলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এ পথে রিকশাচালকরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করছেন। তাই হেঁটেই চকবাজার চলে আসেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘূর্ণিঝড় রেমাল কেড়ে নিল ১২ প্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধমানুষ রাস্তায় নামছে না, তাই কৃষিমন্ত্রী ভাবছেন পণ্যমূল্য সহনশীল