ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

স্মরণ

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৯ মার্চ, ২০২৪ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

মৃত্যুর আগে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বসে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাঁর পরনে ছিলো রিপু করা প্যান্ট ও অনেক বছরের পুরানো শার্ট। সাক্ষাৎকার নেওয়া সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি ছিঁড়া রিপু করা প্যান্ট পরেছেন কেন? তিনি বলেন, এটি এখনো পরা যায় বলেই পরেছি, একটু ছিঁড়া কিন্তু তাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। আরো বললেন, চিন্তা করে দেখলাম দামী পোশাক পরিধান করা অপচয় ছাড়া কিছু নয়।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই লোকটি লন্ডনে এফসিপিএস পড়া অবস্থায় খুবই বিলাসী জীবন যাপন করতেন। ইংল্যান্ডের যে টেইলার চার্লসের স্যুট সেলাই করতো সেই টেইলার তাঁর স্যুটও সেলাই করতো। তিনি কখনো রেডিমেড স্যুট পরতেন না। টেইলর তাঁর বাসায় এসে স্যুটের মাপ নিয়ে যেতো। ব্যবহার করতেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী ব্যান্ডের কাপড় চোপড় ও পারফিউম। তাঁর ছিলো প্রাইভেট প্লেন চালানোর প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স। তিনি যে গাড়িতে চড়তেন সেটি মার্সিডিজ গাড়ির চেয়েও দামী গাড়ি ছিলো। প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন গেলে তাঁর গাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়িতে চড়তেন না।এতো বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ হলেও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবন পরিবর্তন করে দেয়। ১৯৭১ এ হানাদার বাহিনীর আক্রমণে তিনি চরম ক্ষুব্ধ হন। কিভাবে নির্যাতিত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানো যায় সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। নিরাপদ ও আরামদায়ক জীবন ছেড়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনিশ্চিত জীবনে যাত্রা শুরু করেন। ঐসময়ে তাঁর সাহস ও দেশের প্রতি কমিটমেন্টের কথা ভেবে আজো পুলকিত হই।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশকে সহায়তা করার জন্য তাঁর উদ্যোগে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে গঠিত হয়। সে সময় যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি ডাক্তার প্রতি মাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় বাঙালিরা হাইড পার্কে পাকিস্তান বিরোধী একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সে সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিন সাংবাদিকদের সামনে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেন। এরপর তাঁরা দুজন ভারতে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁদের পাসপোর্ট না থাকায় ভিসা পাওয়া নিয়ে সংকট দেখা দেয়। তখন এই দুজন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রাজ্যহীন (স্টেটলেস) নাগরিকের সনদপত্র বের করে তার ভিত্তিতে ভিসা নিয়ে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে করে ভারতের পথে রওনা হন। সিরিয়ার দামেস্কে যাত্রাবিরতি কালে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা সিরিয়ার সরকারের কাছে ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিনকে গ্রেপ্তারের জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু বিমানের পাইলট তাতে বাদ সাধেন। পাইলট বলেন উড়োজাহাজ রানওয়েতে। যা নিরপেক্ষ একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। সেখানে সিরিয়া বা পাকিস্তান কোনো দেশের আইনই প্রযোজ্য হবে না। তিনি কোনো যাত্রীকে বন্দী হস্তান্তরের মতো হস্তান্তর করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা এ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলার পর দীর্ঘ নাটকীয়তা শেষে দামেস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজটিকে ছাড়পত্র দেয়। তারপর দিল্লি ও কলকাতা হয়ে অবশেষে তাঁরা আগরতলা পৌঁছে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করেন। ডা. মোবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ দুজনই যুক্তরাজ্যে এফআরসিএস দ্বিতীয় পর্বে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। তাঁরা এই হাসপাতালের পরিধি এবং কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ডা. মোবিন জেনারেল ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে এফআরসিএস করছিলেন স্কটল্যান্ডে আর ডা. জাফরুল্লাহ সার্জারি ও ভাসকুলার সার্জারিতে লিডসের ইয়র্ক হাসপাতালে। পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তাঁরা দুজন ছিলেন বন্ধু।

যুদ্ধ শেষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চাইলে আবার লন্ডনে ফিরে যেতে পারতেন। শেষ করতে পারতেন পড়াশোনাও। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে গরীব দুঃখী মানুষের অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা ওনার মনে রেখাপাত করে। তাই তিনি লন্ডনে ফেরত না গিয়ে সাভারে শুরু করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কার্যক্রম। সাভারে ধুধু মাঠের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়ে জাফরুল্লাহ তখন নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর পণ ‘বিদেশি টাকা ছোঁব না’। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের টাকায় দেশ গড়ে তুলবো হাসপাতাল। এরি মধ্যে একদিন ডা. জাফরুল্লাহর তাঁবুতে হানা দেন পূর্ব পরিচিত রেমন্ড করনওয়ার। প্রস্তাব দেন আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার।

রেমন্ডকে তিনি তাঁর পেছনে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়ে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু রেমন্ড মানুষ চিনতেন। তিনি বারবার যান সাভারের তাঁবুতে। জাফরুল্লাহকে সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতা বোঝান, নিজের জীবনের উদাহরণ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের পরিবারের চরম অনটনের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেন। সাভারে বৃষ্টিতে কাপড়ের তাঁবু কতটা অচল, তাও তুলে ধরেন। ঘর তাঁকে তুলতেই হবে, আর সেটা করতে হবে বর্ষার আগেই। শেষ পর্যন্ত বাস্তব অবস্থা মেনে রাজি হন ডা. জাফরুল্লাহ, তবে তাঁর শর্তে।

সাংবাদিক লেখক কাজী জাওয়াদ এক নিবন্ধে ডা. জাফরুল্লাহ সম্পর্কে লিখেছেন, ফার্মাসিউটিক্যালসে হামলা চালানো হলো। তখন বেশ কয়েক রাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাভারে পৌঁছে দিয়েছি। তাঁর গাড়িকে ট্রাকের ধাক্কা দেওয়া একসময় নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।

ডা. জাফরুল্লাহ যখন এক হাতে ওষুধ নীতির পক্ষে কাজ শুরু করেন, তখন বামপন্থী শিবিরের কেউ কেউ তাঁর বিরোধিতা করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর একক প্রচেষ্টায় ওষুধনীতি সংক্রান্ত আইন জারির পর তা বানচালের জন্য শুরু হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলা। একটা জনহিতকর সংস্কারের পক্ষে কথিত প্রগতিশীলদের সক্রিয় সমর্থন দূরে থাক বরং বহুজাতিক মুনাফাখোরদের পক্ষ নিয়েছেন অনেকে। এঁদের কেউ কেউ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চাকরি করতেন বলেই যে তাঁরা বহুজাতিকদের সঙ্গে ছিলেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এরপর ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি পাস হয়।

যার ফলশ্রুতিতে দেশের ওষুধ শিল্প একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু আটকে যায় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি। এই নীতিতে মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ নিয়ন্ত্রণের বিধান যুক্ত হওয়ায় চিকিৎসকেরা ধর্মঘট পর্যন্ত করেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলাও হয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধাচরণকে রাজনৈতিক ভাবে সমার্থক করে তোলা হয়েছিল। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নিজেদের সমর্থকদের খেপিয়ে তোলা হয়েছিল।

২০২০ সালে পুরো বিশ্ব যখন করোনা আক্রান্ত তখন আমরা দেখেছি মানুষের জন্য ডা. জাফরুল্লাহর কি পরিমাণ দরদ ও তৎপরতা। কীভাবে স্বল্পমূল্য করোনার চিকিৎসা করা যায় তা তিনি বার বার বলেছিলেন। শরীরে করোনার উপস্থিতি নির্ণয়ের সহজলভ্য পদ্ধতি বা কীট আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী ড. বিজনকে দিয়ে গবেষণার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রিএজেন্ট এনেছিলেন এবং এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। যদিও বার বার বলার পরেও কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

এরপর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, আদালত অবমাননার মতো নানা অভিযোগ আনা হয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু যতই ডা. জাফরুল্লাহকে অপমান, অপদস্ত, ছোট ও হেয় করার প্রয়াস দেখেছি, ততই তিনি স্বমহিমায় আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন।

প্রয়াত রেমন্ড করনওয়ার শেষবার যখন ঢাকায় আসেন, তখন গণস্বাস্থ্যের নগর হাসপাতালে ডা. জাফরুল্লাহ তাঁর সব নতুন পুরোনো সহকর্মীদের ডেকেছিলেন। অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার উদ্যোক্তা ও কর্মীদের অনেকেও ছিলেন। সেখানে কথা প্রসঙ্গে রেমন্ড বলেছিলেন, ‘পারহ্যাপস হি ইজ দ্য মোস্ট মিসআন্ডারস্টুড পারসন ইন আওয়ার টাইম’। যার অর্থ, ‘আমাদের কালে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল বুঝেছে তাঁকে।’ রেমন্ড বলেন, ‘তোমরা তাঁকে এনজিও নেতৃত্বে ডেকে এনেছিলে, এডাবের (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সংগঠন) চেয়ারম্যান করেছিলে। আবার মেয়াদ শেষ না হতেই তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছ। তোমাদের অনেক ভাগ্য তাঁর মতো একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক মানুষ তোমরা পেয়েছিলে।’

আসলে জাতি হিসাবে আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ। যোগ্য লোককে কখনো আমরা সঠিক মূল্যায়ন বা সম্মান দিই না। তবে একটি কথা বলা যায় এই দেশ যতদিন থাকবে ডা. জাফরুল্লাহর ত্যাগ তিতিক্ষা দেশপ্রেম ততদিন বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে সম্মান, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফৌজদারী মামলার বিভিন্ন ধাপসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধহিমোডায়ালাইসিসে সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্ব