আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার নেতৃত্ব পেয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেনের কাছ থেকে, যদিও তার বহু বছর আগে থেকেই তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক এ জঙ্গি সংগঠনের প্রধান সংগঠক, কৌশলবিদ ও আধ্যাত্মিক নেতা। রয়টার্স লিখেছে, কঠিন সময়ে সংগঠনের নেতৃত্বে আসা জাওয়াহিরি সেই কারিশমা দেখাতে পারেননি, যা দিয়ে অভাবনীয় হামলায় আবারও পশ্চিমকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো হামলা চালাতে অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করা যায়। আর প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গি দল ইসলামিক স্টেটও তার সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। গত রোববার সকালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন ৭১ বছর বয়সী জাওয়াহিরি। খবর বিডিনিউজের।
২০১১ সালে আরব বসন্তের সূচনায় মধ্যবিত্ত অধিকারকর্মী আর বুদ্ধিজীবীরা যখন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে লাগলেন, জাওয়াহিরি হতাশা নিয়ে দেখলেন, তার সংগঠন আল-কায়েদা ধীরে ধীরে প্রচারের আলোর বাইরে চলে যাচ্ছে। ওই বছর ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন কমান্ডো হামলায় নিহত হন আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন। সংগঠনের নেতৃত্বের ভার চাপে তার কাঁধে। কিন্তু পরের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে তার সেনাপতিরা একের পর এক নিহত হতে থাকে। ফলে বর্ষিয়ান এই মিশরীয় জঙ্গির বিশ্বজুড়ে আক্রমণ শানানোর ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যায়।
একজন অনমনীয় ও যুদ্ধংদেহী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও জাওয়াহিরি কৌশল বদলাতে বাধ্য হন। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছোট ছোট চরমপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে আল-কায়েদা। আর এর মধ্য দিয়ে দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলার বিস্তার ঘটান এই জঙ্গি নেতা। এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশকে অস্থিরতায় ডুবিয়ে দেয় সেই সহিংসতা। কিন্তু যে আল-কায়েদার পরিকল্পনায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা পুরো বিষয়ে আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়েছিল, সেই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আর স্তরভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো ততদিনে অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে।
ইসলামি জঙ্গিবাদে জাওয়াহিরির হাতেখড়ির ইতিহাস পুরনো। বিশ্ব তার নাম প্রথম শোনে ১৯৮১ সালে, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল-সাদাত হত্যা মামলায় যখন তাকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হলো। সাদা আলখেল্লা পরিচিত জাওয়াহিরি সেদিন আদালতে চিৎকার করে বলেছিলেন, অনেক ত্যাগ আমরা স্বীকার করেছি, ইসলামের বিজয়ের জন্য আরও ত্যাগ আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের সঙ্গে সাদাতের করা শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে আদালতে স্লোগান দিচ্ছিলেন জাওয়াহিরি আর তার সঙ্গী বন্দিরা। অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে সেবার তিন বছরের জেল হয়েছিল জাওয়াহিরির। তবে সাদাত হত্যার মূল অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পেয়েছিলেন।
চক্ষু চিকিৎসক জাওয়াহিরিকে শুধু ‘ডাক্তার’ বলেই ডাকতেন তার সঙ্গীদের অনেকে। মিশরের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চলে যান পাকিস্তানে। সেখানে রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে যোগ দেন। তখনকার সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে আহত আফগান মুজাহিদিন গেরিলাদের সেবা দিতেন। সেসব দিনেই লাদেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
১৯৯৩ সালে মিশরের উগ্রপন্থি দল ইসলামিক জিহাদের নেতৃত্বে আসেন জাওয়াহিরি। অবশ্য নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তিনি মিশরে সরকার উৎখাত করে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। সেই আন্দোলনে নিহত হয়েছিলেন ১২শর বেশি মিশরীয়।
১৯৯৫ সালের জুনে আদ্দিস আবাবায় প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারককে হত্যার একটি ব্যর্থ চেষ্টার পর ইসলামিক জিহাদের কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে মিশর সরকার। জবাবে ১৯৯৫ সালে ইস্তাম্বুলে মিশর দূতাবাসে হামলা চালায় জাওয়াহিরির দল। বিস্ফোরণে প্রাণ যায় ১৬ জনের।
১৯৯৯ সালে মিশরের সামরিক আদালত পলাতক জাওয়াহিরিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার পলাতক জঙ্গি জীবন। তার সহযোগিতায় বিন লাদেন প্রতিষ্ঠা করেন আল-কায়েদা। ২০০৩ সালে আল জাজিরায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে আল-কায়েদার এই দুই শীর্ষ নেতাকে কোনো এক পাহাড়ি এলাকা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ওই ছবি দেখেই তাদের খুঁজে বের করার আশা দেখতে শুরু করে পশ্চিমা গোয়েন্দারা।
বেশ কয়েক বছর ধরে জাওয়াহিরি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে গোপন আশ্রয়ে ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ২০১১ সালে মার্কিন নেভি সিল পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর আল-কায়েদার হাল ধরেন তিনি। আর তখন থেকেই বাহুর নিচে একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে ভিডিও বার্তায় হাজির হয়ে বারবার জিহাদের ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। বিন লাদেনকে হত্যার বদলা নিতে জাওয়াহিরি পশ্চিমাদের ওপর আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ায় আবির্ভূত হয় ইসলামিক স্টেটের নামের নতুন এক জঙ্গি দল। আরও উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ড দিয়ে তারা পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীগুলোর নজর কেড়ে নেয়। জাওয়াহিরি প্রায় ধর্মের ধুঁয়া তুলে অনলাইনে বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদের উদ্বেলিত করার চেষ্টা করতেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি অথবা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকার বিষয়ে বক্তব্য দিতেন। বিন লাদেনও মানুষকে বিমোহিত করতে একই কৌশল ব্যবহার করতেন।
আল-কায়েদার সব থেকে বড় অপারেশনগুলোতেও জাওয়াহিরি সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে মনে করা হতো। ২০০১ সালে বিমান ছিনতাই করে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালিয়ে ৩ হাজার মানুষ হত্যার আয়োজনেও তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এফবিআই তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা জাওয়াহিরির মাথার দাম ঘোষণা করেছিল আড়াই কোটি ডলার।
১৯৫১ সালে মিশরের কায়রোর এক স্বনামধন্য পরিবারে জন্ম হয় তার। মিশরের বিখ্যাত আল-আজহার মসজিদের গ্রান্ড ইমামের নাতি তিনি। পশ্চিমা অভিবাসী অধ্যুষিত কায়রোর জনবহুল শহরতলী মাদিতে বেড়ে উঠেন জাওয়াহিরি, যাদের তিনি প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। ইসলামি মৌলবাদের প্রথম দীক্ষা তিনি পেয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সে। ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিশরীয় লেখক সায়্যিদ কুতবের বিপ্লবী চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন।
জাওয়াহিরির সঙ্গে যারা কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে পড়েছেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জাওয়াহিরি সে সময় ছিলেন একজন প্রাণবন্ত যুবক, যিনি সিনেমা দেখতে যেতেন, গান শুনতেন আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাততেন। তার সমসাময়িক এক চিকিৎসক বলেন, কারাগার থেকে যখন বের হলেন, সেই জাওয়াহিরি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা জাওয়াহিরিকে আরও মৌলবাদের দিকে নিয়ে গেছে।