‘ঠান্ডা মিয়া, সন অব রাঙ্গুনিয়া’

ওয়ার সিমেট্রিতে সমাধি, খবর রাখেনি কেউ

জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া | শনিবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্টি। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ভিনদেশী যোদ্ধাদের সারি সারি সমাধিস্থল। সেখানে গেলে চোখ আটকে যায় একটি সমাধি ফলকের দিকে। যেখানে লেখা রয়েছে দঞযধহফধ গরধ ঝড়হ ড়ভ জধহমঁহরধ.্থ। ঠান্ডা মিয়া রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি গ্রামের পূর্ব পাড়ার সন্তান। যার খবর রাখেনি কেউ। এত বছরেও মেলেনি এই বীরের স্বীকৃতি। উঠে আসেনি তাঁর বীরত্বের গল্প। এর কিছুই জানেন না তার স্বজনরাও। শুধু বংশ পরম্পরায় স্বজনরা জানেন, ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তীব্র হয়ে উঠছিলো তখন যুদ্ধে শহীদ হন তিনি এবং তার শেষ ঠিকানা হয় চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্টিতে ভিনদেশী যোদ্ধাদের পাশে। তার মা ১৯৬৭ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঠান্ডা মিয়ার অবসরকালীন ভাতা পেয়েছিলেন বলে স্বজনরা জানান। এরপর থেকে আর খবর রাখেনি কেউই, উঠে আসেনি তার বীরত্বের কোন গল্প।

সামপ্রতিক সময়ে দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে এসেছে চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রির কথা। কারণ গত নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১৮ জন জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয়। তাঁদের দেহাবশেষ ফিরে যাচ্ছে তাদের স্বদেশে, তাদের পরিবারের স্মৃতির কাছে। এই সৈন্যদের দেহাবশেষ উত্তোলনে ১০ সদস্যের জাপানি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চল তাঁদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছিল। সেখানে প্রতিটি কবর খনন করা হয়, নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং মর্যাদার সঙ্গে হস্তান্তর করা হয়। একদিকে যখন ভিনদেশী যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চরম অবহেলায় পড়ে থাকা ঠান্ডা মিয়ার একটি অপ্রকাশিত অধ্যায় অব্যক্ত থেকে গেছে। ভিনদেশী সৈনিকদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া হলেও, নিজ দেশেই স্বীকৃতি মিলেনি ভিনদেশী

যুদ্ধে নিহত এই বীর সৈনিকের।

জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের গোল পাহাড়ের মোড় হয়ে ডান দিকে বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়ক। ৫০ গজের মতো গোল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ৭ একর জায়গাজুড়ে এই ওয়ার সিমেট্রি। সেখানে শায়িত রয়েছেন বিভিন্ন দেশের তিনজন নারী সৈনিকসহ সেনা ও বিমানবাহিনীর ৭৫১ জন যোদ্ধা এবং বেসামরিক চারজন ব্যক্তি। এ ছাড়া ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে সমাহিত হয়েছেন ৭৩৭ জন। তাঁদের মধ্যে ৭৩৬ জন যোদ্ধা ও একজন বেসামরিক ব্যক্তি। তাঁরা সবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছিলেন। কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের তথ্যভান্ডার ও বইয়ে উল্লেখিত তথ্য রয়েছে।

সরেজমিনে রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি পূর্বপাড়া গ্রামে গেলে জানা যায়, মাবাবার পাঁচ বোনের একমাত্র ছেলে ছিলেন ঠান্ডা মিয়া। ছিলেন অবিবাহিত। বর্তমানে তার পাঁচ বোনও মারা গেছে। শুধুমাত্র বেঁচে আছেন বোনের ছেলেরা। এর মধ্যে ঠান্ডা মিয়ার ভিটায় থাকেন তাঁর ছোট বোনের ছেলে মোহাম্মদ মুছা তৈয়্যবী। মা ও নানীর মুখে মামার সাহসিকতার অনেক গল্প শুনেছিলেন তিনি। রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন ঠান্ডা মিয়া। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। চারদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝেই ১৯৪০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েই যুদ্ধে যোগ দেন এবং লড়েন ব্রিটিশ পরিচালিত মিত্রবাহিনীর হয়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে জাপানিদের সাথে বার্মা সীমান্তে একটি যুদ্ধে বুকে গুলি লাগে তাঁর। এরপর চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টিয়ান হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার একপর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে তার সমাধিফলকের তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর সমাহিত করা হয়েছিলো তাঁকে। ঠান্ডা মিয়ার স্মৃতির মধ্যে শুধু তাঁর ব্যবহৃত একটি ট্রাংক সংরক্ষিত আছে স্বজনদের কাছে। যেটি তিনি মারা যাওয়ার পর পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয়েছিলো। এলাকার মানুষের আকুতি, জাপানি সৈন্যদের খবর খোঁড়া হলেও এখনো অব্যক্ত থেকে যাওয়া ঠান্ডা মিয়ার বীরত্বের ইতিহাস যেনো তুলে আনা হয়। যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে উন্মোচন করা হয় তাঁর কোনো যুদ্ধদিনলিপি কিংবা তাঁর বীরত্বের যেনো সঠিক মর্যাদা দেয়া হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে বাইকের ধাক্কায় তরুণ নিহত
পরবর্তী নিবন্ধ৪১টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিল সরকার