গ্রাম বাংলার মেঠো পথ ধরে যদি এগিয়ে যান তবে দেখা যাবে পথ সহজে শেষ হয় না। বিশেষ করে গ্রীষ্মের ভর দুপুরে অথবা আষাঢ়–শ্রাবণ মাসের ক্রমাগত বৃষ্টিস্নাত দিনে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের গ্রামের প্রায় সব রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা এবং ভাঙ্গা। এখনো মনে আছে, শ্রাবণের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে অতি জরুরি প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল উত্তর রাউজানের এক জনপদে। আর আমাদের বাড়িটি ছিল দক্ষিণ রাউজানের প্রায় শেষ প্রান্তে ১৪নং বাগোয়ান ইউনিয়নে। আমি আর আমার সমবয়সী ভাইপো রণজিত যথাসময়ে সকালে রাওয়ানা হয়ে বাড়ির উত্তরদিকে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে। দুইজনের ছাতা মাত্রা একটা। স্বাভাবিকভাবে আমি বৃষ্টির রোষানল থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করলে সে ভিজে যায়। আর সে চেষ্টা করলে আমি ভিজে যাই। অবশেষে দুইজনই ভিজে জবুথুবু। কিন্তুু হাঁটা থামাইনি। কারণ আমাদেরকে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে হবে। যতই হাঁটি বেশিদূর আগানো যায় না। কারণ রাস্তা ছিল কাদাযুক্ত। কাদাযুক্ত বললে ভুল হবে। সর্বত্র কাঁচা মাটির রাস্তা। তাই বর্ষাকালে ক্রমাগত চার–পাঁচ দিন ধরে বৃষ্টি পড়ার কারণে এক পা সামনে আগালে অন্তত তিন ইঞ্চি এমন কি কোনো কোনো জায়গায় পাঁচ ইঞ্চি পর্যন্ত পা মাটির নীচে ঢুকে যায়। এই যেন অনেকটা এভারেস্ট বিজয়ের মত। এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে বদ্ধপরিকর আরোহীদের কোনো কোনো জায়গায় তাদের পা, বরফের নীচে প্রায় পাঁচ থেকে আট ইঞ্চি পর্যন্ত ঢুকে যায়। সেই সময়ে গ্রাম বাংলার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল এ রকম। যা– হোক প্রায় ছয় ঘণ্টা হেঁটে উত্তর রাউজান থেকে দক্ষিণ রাউজান এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম যা এখনো মানস চক্ষে স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই সময়ে গ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদের রাস্তাগুলো কাঁচা ছিল বলে তেমন কোন গাড়ী এসব রাস্তা দিয়ে চলতো না। শুষ্ক মৌসুমে দুই একটা রিক্সা চলাচল করতো গ্রাম বাংলার নব বধূদেরকে নিয়ে। রিক্সার পিছনের সিটে মেয়েরা বসতো। আর রিক্সার হুক তুলে দিয়ে সম্পূর্ণ রিক্সার ছাউনিটিকে একটি কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হতো। বিশেষ করে মহিলাদের পর্দাশীলতার কারণে এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যেহেতু গ্রামবাংলার বিস্তৃীর্ণ জনপদে অধিকাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র সেহেতু এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল পায়ে হেঁটে যাওয়া। আর পর্দাশীলতার কারণে অধিকাংশ মহিলা যাতায়াত করতো পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোতে। যান্ত্রিক যান না থাকার কারণে পায় হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ায় একমাত্র অবলম্বন ছিল। আর শহরাঞ্চলেও এত সুন্দর সুন্দর রাস্তাঘাট ছিল না। গাড়ীর পরিমাণ ছিল অনেক কম। কিছু সংখ্যক রিঙা টিং টিং করে চলাচল করত। ১৯৭৬ সালে যখন অনার্সে পড়ি তখন কাপ্তাই রোড দিয়ে যে বাসগুলো চলাচল করতো সেগুলো ছিল কাঠের তৈরি। বেডফোর্ট ইঞ্জিন লাগিয়ে এসব গাড়ী চলাচল করতো। চট্টগ্রাম শহর থেকে কালুঘাট যাওয়ার জন্য এক প্রকার ছোট ছোট বাস ছিল, যাদেরকে বলা হতো ‘মুড়ির টিন’।
এরূপ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে ট্রাফিক আইনের তেমন প্রয়োজন ছিল না। ফলে ট্রাফিক আইনের এত কড়াকড়িও ছিল না। তাছাড়া মোটরসাইকেল নামক এই যানটি তেমন দেখা যেত না। কালে ভাদ্রে দুই একটি দেখা গেলেও সেই সব মোটর সাইকেলের স্টার্ট দিতে হতো পায়ের হ্যান্ডেল দিয়ে। আকারেও ছিল অনেক ছোট। কিন্তুু সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের আয়, রোজগারের পরিবর্তন হয়েছে। জীবনযাত্রা মানেও উন্নয়ন ঘটেছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষ জীবন যাপনের জন্য নতুন নতুন পণ্যের ব্যবহার শিখেছে। জীবনকে উপভোগ করার জন্য ‘জেন–জি’রা অত্যাধুনিক পণ্যগুলো ব্যবহার করছে। বিদেশ থেকে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রকারের গাড়ী আমদানি করা হয়েছে। এই হাজার হাজার গাড়ীর মধ্যে মানুষ পারিবারিকভাবে ব্যবহার করার জন্য, সৌখিনভাবে যাতায়াত করার জন্য, যুব সমাজ ও মধ্যবিত্ত লোকেরা সহজে একজন বা দুইজন চলাচলের জন্য যানও রয়েছে। সরকার কর্তৃক গাড়ী বিভাজন করা হয়েছে চাকা অনুসারে। দুই চাকার গাড়ী, তিন চাকার গাড়ী, চার চাকার গাড়ী এবং ক্ষেত্র বিশেষে আট থেকে ততোধিক চাকার গাড়ীও রয়েছে যেগুলো বড় বড় মালামাল বা অত্যধিক ওজনের মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। সব ধরনের গাড়ী চালানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ট্রাফিক বিভাগ আন্তর্জাতিক নিয়মের সাথে সংগতি রেখে বেশ কিছু আইন করেছে। আর গাড়ী চালকদের দক্ষতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন লাইসেন্স ও দিয়ে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা বাদ দিলে লাইট লাইসেন্সধারী ও হেভি লাইসেন্সধারী চালকেরা অনেকাংশে নিয়ম মেনে গাড়ী চালিয়ে থাকে। তারপরও কিছু দুর্ঘটনা যে হয় না– তা কিন্তুু নয়। যেমন– বড় বড় শহরগুলোতে দ্রুত যাওয়ার প্রতিযোগিতা দুর্ঘটনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ প্রবণতাকে যদি রোধ করা যায় তবে দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কিন্তুু যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তা হলো মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল আরোহীদের বা চালকদের ভাবখানা এমন যে, তারা বাংলাদেশের সর্বত্র রাস্তাঘাট কিনে নিয়েছে। বাংলাদেশের কিছু মোটর চালক ট্রাফিক আইন মেনে চললেও অধিকাংশ শহরগুলোতে ট্রাফিক আইন মেনে চলার কোন বালাই নেই। তারা মনে করে তাদের কথায় আইন। হেলমেট ছাড়া দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে যদি কোনো ব্যক্তিকে ধাক্কা দেয় তবে এতে কোনো দুঃখ প্রকাশ তো করেই না, বরং উল্টো কথা। এমন ভাব দেখায়, আপনি (পথচারী) এভাবে একপাশ দিয়ে চলছেন কেন? তাদের সাথে কোনো পথচারী যদি তর্কে লিপ্ত হয় তবে ঐ পথচারীর কোনো রেহাই নেই। নির্ঘাত শারীরিক হেনস্তা অথবা অপমানিত হয়ে পথচারীকে ফিরতে হয়। ঘটনাস্থলে যদি সেইভাগ্যক্রমে ট্রাফিক থাকে তবে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়।
ঢাকা সহ কয়েকটি শহরে ইদানিং মোটরচালকদের জন্য কতগুলো ট্রাফিক অনিয়ম, নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাফিক আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ফুটপাত হচ্ছে পথচারীদের হাঁটার জায়গা। রাস্তায় গাড়ী চলবে, আর ফুটপাতে পথচারী হাঁটবে। সেদিন মেয়ের বাসা থেকে বের হয়ে ওয়ারীর ফুটপাতে হেঁটে অন্যত্র যাচ্ছি। রাস্তায় অসংখ্য গাড়ী। আশ্চর্যের বিষয়, ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল এসে এক বয়স্ক পথচারীকে ধাক্কা দিল। পথচারী বেশ আঘাত পায়। আমরা দুই একজন এগিয়ে গিয়ে মোটরসাইকেল চালককে জিজ্ঞাস করি– ভাই, ফুটপাত তো হাঁটার জায়গা। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই চালক উত্তর দিয়ে বসলো– এইটাই নাকি ট্রাফিক নিয়ম। অল্প বয়সী ভয়ংকর আচরণধারী চালকের ব্যবহার ও অঙ্গভঙ্গি দেখে আমরা তিনজনই চুপ হয়ে গেলাম। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর। উল্লেখ্য যে, ঐ চালকের মাথায়ও হেলমেট ছিল না। এ প্রবণতা ট্রাফিক পুলিশকে বাধা দিতে হবে। কারণ তারা আইন প্রয়োগকারী নির্ধারিত সংস্থার লোক। তা না হলে দুর্ঘটনা কখনো কমবে না। বাংলাদেশে সর্বাধিক দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেল। ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’– এর একটি তথ্য আমার হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪– এ পাঁচ বছরে এগার হাজার ৮৬৪ জন মোটরসাইকেল আরোহী প্রাণ হারিয়েছে যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৬৭ শতাংশ। ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী অর্থাৎ বিগত ১৩ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ হাজার ৭৯৮ জন মোটরসাইকেল আরোহী ছিল। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আর এই দায়িত্ব হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।