আজকের বিশ্বায়নের এই যুগে টেকসই উন্নয়নের সাধনা বিশ্বব্যাপী জাতিসমূহের জন্য একটি প্রধান লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি কাঠামো প্রদান করে। এই লক্ষ্য সমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং সবার জন্য শোভন কাজ বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮ নং লক্ষ্যের কেন্দ্রে রয়েছে শোভন কাজের ধারণা যা ন্যায্য মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ কর্মসংস্থানের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। শোভন কাজের ধারণা কেবল শ্রমিকদের মঙ্গলই বাড়ায় না বরং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা শোভন কাজের একটা মৌলিক দিককে প্রকাশ করে। এটা একটি কাজের মৌলিক পরিবেশের বিধানের সাথে সম্পর্কিত যা শ্রমিকের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থ্যতা রক্ষা করে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা শুধু একটি নৈতিক বাধ্যবাদকতা নয় বরং বিশ্বব্যাপী নিয়োগকর্তা এবং সরকার সমূহের জন্য একটি আইনী বাধ্যবাদকতাও বটে।
একটি নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ:
১) মানব পুঁজি রক্ষা: শ্রমিকেরা যেকোন দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আধুনিক বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষকে মানব পুঁজি হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অসুস্থতা প্রতিরোধের মাধ্যমে জীবন ও উৎপাদনশীলতার ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হয় এবং পাশাপাশি শ্রমিকের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করা গেলে মানব পুঁজি সুরক্ষিত থাকে।
২) উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা: নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি শ্রমিক কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধি করে, যার ফলে উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, যখন শ্রমিক কর্মচারীরা মূল্যবান বা সুরক্ষিত বোধ করেন তখন তারা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চালিত করে এবং তারা তাদের সেরাটা উপহার দেয়ার জন্য সচেষ্ট থাকে।
৩) অর্থনৈতিক বোঝা হ্রাস করা: কর্মক্ষেত্রে আঘাত এবং অসুস্থতা ব্যক্তি–পরিবার ও সমাজের উপর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দেয়। দুর্ঘটনা বা পেশাগত রোগের কারণে চিকিৎসা, পুনর্বাসনের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করার প্রয়োজন হতে পারে আবার সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের কর্ম দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। ফলে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হ্রাসের মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়গুলি প্রতিরোধ করা গেলে দেশের অর্থনীতির উপর অনাকাঙ্ক্ষিত বোঝা হ্রাস পায় ফলশ্রুতিতে দেশের সম্পদ ও অর্থনীতি কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।
৪) সামাজিক নিরাপত্তার উন্নয়ন: একটি দেশের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যায়। এটি সকল ব্যক্তিবর্গকে তাদের পেশা ও আর্থ সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে তাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বিষয়ে ঝুঁকিমুক্ত হয়ে কাজ করার অধিকারের বিষয়ে নিশ্চয়তা বিধান করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮ নং গোল তথা শোভন কাজের উদ্দেশ্য সমূহ অর্জনের জন্য সরকার নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনসহ অন্যান্য অংশীজনদের অবশ্যই শক্তিশালী নীতি এবং অনুশীলনীগুলি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে হবে যা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়। এর মধ্যে রয়েছে:
১) আইন ও প্রবিধান: কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার মান নিয়ন্ত্রণ করে এমন আইন ও প্রবিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। এই প্রবিধানগুলো বিপজ্জনক ইস্যু সমূহ শনাক্তকরণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন, নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহারের বাধ্যবাদকতার বিধানসহ বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
২) প্রশিক্ষণ প্রদান: কর্মক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ চিহ্নিত করতে এবং কার্যকরভাবে ঝুঁকি কমানোর জন্য মালিক–শ্রমিক সবার পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মালিক এবং শ্রমিক উভয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় মালিক–শ্রমিক যৌথভাবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। ফলে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হয়।
৩) নিয়মিত তদারকি ও আইন প্রয়োগ: কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট, বয়লার পরিদর্শন, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত রয়েছে। একটি উপযুক্ত চেকলিস্ট তৈরি করে সেই মোতাবেক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরিদর্শন শেষে কোথাও কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে তা সাথে সাথেই সংশোধনের উদ্যোগ থাকতে হবে, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়মিত তদারকি এবং আইন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক প্রত্যেককে জবাদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উক্ত দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের যথাযথ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান থাকতে হবে।
৪) নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তোলা: নিরাপত্তার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য নিয়োগকর্তা, শ্রমিক এবং প্রাসঙ্গিক স্টকহোল্ডারদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, যোগাযোগ এবং সহযোগিতা একান্ত প্রয়েজন। নিয়োগকর্তাদের উচিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে খোলামেলা কথোপকথনের সুযোগ সৃষ্টি করা, প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই শ্রমিকদের বিপদ বা ঝুঁকি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে উৎসাহিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের সক্রিয়ভাবে জড়িত করা উচিত।
৫) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা সমূহের সাথে যোগসূত্র তৈরি করা: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৩ নং লক্ষ্য সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ, ৫ নং লক্ষ্য লিঙ্গ সমতা এবং ১০ নং লক্ষ্য বৈষম্য হ্রাসকরণ ইত্যাদি লক্ষ্য সমূহের সাথে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে একটা নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কর্মস্থলে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পারস্পরিক সম্পর্কিত লক্ষ্যসমূহ একীভূত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র মানব স্বাস্থ্য, মঙ্গল এবং সামাজিক ন্যায্যতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব সর্বোচ্চ করতে পারে।
উপসংহারে বলতে চাই, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সকলের জন্য উপযুক্ত কাজ এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিৎ যেখানে শ্রমিকদের সার্বিক অধিকার সুরক্ষা পাবে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং সমাজের সামগ্রিক মঙ্গল ও স্থায়িত্বে অবদান রাখবে। আরও ন্যায়সঙ্গত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্যে আসুন আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সাথে আপস না করে মর্যাদার সাথে কাজ করার সুযোগ পাবে।
লেখক: কো–অর্ডিনেটর, ওশ সেন্টার, বিলস–ডিটিডিএ প্রকল্প।