কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় চিহ্নিত শিবির ক্যাডার ও ছাত্রদল নেতাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ছিল তাদের মূল টার্গেট। সিসি ক্যামরার ফুটেজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষণ করে জড়িত বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সরকারি সম্পদ ধ্বংস পরিকল্পনার তথ্যও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ–পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৩ সালে সহিংসতায় যুক্তরা এবারও সক্রিয় ছিল। পরিকল্পনাই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা। এদের অনেককেই এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে জামিন পেয়ে তারা একই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতেই নাশকতা চালানো হয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামে মূলত ১৬ জুলাই থেকে পরিস্থিতি অবনতি হতে শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রণকৌশল অনুযায়ী মাঠে পুরো শক্তি নিয়ে সেদিনই মাঠে নামে। এজন্য তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্রদলের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন এলাকায়। নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, চকবাজার, বহদ্দারহাট ও আন্দরকিল্লা এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই মজবুত। কোটা বিরোধীদের আন্দোলনের সময় মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, ষোলশহর এলাকার অলিগলি ও পাড়া মহল্লায় শিবিরের ক্যাডারদের আশ্রয়ও দিয়েছিল সেসব এলাকার বাসিন্দারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরপরই সেসব এলাকা ফের অবরুদ্ধ করে দিত কোটাবিরোধীরা। শুধু তাই নয়, কর্মসূচি পালনের সময় দুই নম্বর গেটের মোড় কোটা বিরোধীরা দখলেই রাখত।
অপরদিকে বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁও এলাকায় গত ১৮ ও ১৯ জুলাই আগুন, ভাঙচুর, সংঘর্ষ চালায় নগর বিএনপির নতুন দায়িত্ব পাওয়া এক শীর্ষ নেতার অনুসারীরা। যা ওই নেতা প্রত্যক্ষ দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দেন। পুলিশ ও র্যাবকে দফায় দফায় চান্দগাঁও এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়। চট্টগ্রামে থানায় হামলা ও পুলিশ বঙ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে চান্দগাঁও এলাকায়। পুলিশ বঙে আগুন নিয়ে লাইভ ভিডিও দিয়েছে কোটাবিরোধীরা।
নগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা শীর্ষ দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিসিটিভিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু শনাক্ত হয়েছে। যা মামলার তদন্তকার্যে মূল্যবান। কারণ আমরা অনেককে শনাক্ত করেছি বিভিন্ন ভিডিও ও ছবির মাধ্যমে। অনেক এলাকার সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলেছে তারা পরিকল্পিতভাবে। যারা বিশৃঙ্খলায় ছিল তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান এখনো অব্যাহত। তারা অনেক গডফাদারের নাম বলেছে। অনেকে ভাড়ায় এসেছে, অনেক বিএনপি নেতা–কর্মী সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিয়ে জড়ো করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করেছে। থানায় হামলা চালিয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। দফায় দফায় রাস্তা ব্লক করে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। এদের সঙ্গে ছাত্র অধিকার, ছাত্রদল, শিবিরের নেতা আছে। যারা অতীতেও নাশকতায় যুক্ত ছিল।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুলাই আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হওয়া মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের নেতাকর্মী। মসজিদে এবং মসজিদ মার্কেটে বাঁশ, ইট জড়ো করার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় বিএনপি নেতাদের। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন টেরিবাজারের দোকান মালিক ও কর্মচারীরা। এর আগে দুর্গা পূজায় জেএমসেন হল পূজা মণ্ডপে হামলায় জড়িত ছিল টেরিবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক এক নেতাসহ অসংখ্য দোকান কর্মচারী। যারা জামিনে আছেন তারা যেমন যুক্ত হয়েছেন একইভাবে নতুন কিছু মুখের সন্ধানও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে অনেক যুবককে পুলিশ শনাক্ত করেছে যারা বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে শুক্রবার আন্দরকিল্লা ও লালদীঘি এবং নিউমার্কেট এলাকার নাশকতায় যুক্ত হয়। ফলে পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে দায়িত্ব ছিল একেকভাগে একেকজন নেতার।
নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে সিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের ওপর হামলার নির্দেশ দাতা হিসেবে আনাছ উদ্দিন চৌধুরী নামে এক শিবির কর্মীর নাম এসেছে। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের এই শিক্ষার্থী গত ১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে সেদিন চান্দগাঁও থানা ও পুলিশ বক্সেও আগুন দেওয়া হয়।
সেদিন বহদ্দারহাটে সক্রিয় ছিলেন মহসিন কলেজ ছাত্রদলের সহ–সভাপতি আবদুল আলী রাব্বী। নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও চিত্রও ধারণ করেন তিনি। আগুন জ্বালানোর নির্দেশনার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা ও ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেন। পুলিশ ইতোমধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম ওবায়েদুল হক।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর আজাদীকে বলেন, মঙ্গলবার (২৪ জুলাই) রাতে নগরীর চন্দনপুরা ডিসি রোড থেকে হামিদ হোসেন নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। বর্তমানে চকবাজার থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, হামিদ গত ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে কোটা আন্দোলনের নামে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। এর ভিত্তিতে তার অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করেছি। দুই হাতে ইট নিয়ে সহিংসতায় অংশ নেয়ার ছবি তার মোবাইলেও আমরা পেয়েছি। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য তাকে সেখানে হস্তান্তর করা হয়েছে।