তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে সংঘর্ষে জড়ায় তাবলিগ জামাতের মাওলানা জুবায়ের আহমদ ও দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা। তাতে অন্তত ৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা জুবায়ের অনুসারী কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু এলাকার বাচ্চু মিয়া (৭০), ঢাকার দক্ষিণখানের বেড়াইদ এলাকার বেলাল হোসেন (৫৫) এবং মাওলানা সাদের অনুসারী বগুড়ার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম (৬৫)। অপর নিহতের পরিচয় তৎক্ষণাৎ নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
গাজীপুর পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী শুক্রবার (কাল) থেকে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে পাঁচ দিন জোড় ইজতেমা করতে চান মাওলানা সাদের অনুসারীরা। মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা তাদের এখানে ইজতেমা করতে দিতে চান না। এ জন্য আগে থেকে ইজতেমা মাঠ দখলে নেন জুবায়ের অনুসারীরা। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে চারদিক থেকে মাঠে প্রবেশ করতে থাকেন সাদের অনুসারীরা। মাঠের ভেতর থেকে জুবায়ের অনুসারীরা ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। জবাবে সাদের অনুসারীরাও পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে সাদপন্থীরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। পরে দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাবলীগের দুই পক্ষের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এসময় তিনি দুই পক্ষকেই ইজতেমা মাঠ খালি করে দিতে বলেন। পরে ইজতেমার মাঠ ও আশপাশের তিন কিলোমিটারের মধ্যে সভা–সমাবেশ ও দুই জনের বেশি জমায়েত হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গাজীপুর পুলিশ। নিষেধাজ্ঞার পর ময়দান ছাড়তে শুরু করে লোকজন। বুধবার গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের সাথে বিশেষ আলোচনা সভা শেষে বলেছেন, টঙ্গী ইজতেমা মাঠে হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, যারা টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠ নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনায় জড়িত, তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এতে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। খুনিদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। যারা প্রকৃত দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে এসে ছাড় দিতে হবে। তবেই আমরা একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল বিশ্ব ইজতেমা উপহার দিতে পারব। উপদেষ্টা এ সময় বিশ্ব ইজতেমার মাঠে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফেরাত এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনসহ অনেকে।
বৈঠকে উপস্থিত মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের অন্যতম নেতা মামুনুল হক বলেন, ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর তুরাগ তীরে যা ঘটেছে, তারপর আর দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের সেখানে ইজতেমা করার সুযোগ দেয়া যায় না। তিনি বলেন, সাদপন্থিদের ইজতেমা হওয়ার আর কোনো অবকাশ এখন নেই।
প্রসঙ্গত, তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষ দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভি এবং বাংলাদেশের কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের বিরোধের শুরু ২০১৯ সালে। আগে এক মঞ্চ থেকে একবারই বিশ্ব ইজতেমা হলেও মতভেদের কারণে দুই পক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাঝে কোভিড মহামারীর কারণে ইজতেমা দুই বছর বন্ধ থাকে। ২০২২ সাল থেকে ফের ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বের আয়োজনে। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও টঙ্গীর তুরাগ তীরে দুই পর্বে হবে তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে বড় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। আগামী বছর প্রথম পর্বে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ইজতেমায় অংশ নিবেন জুবায়েরপন্থিরা এবং দ্বিতীয় পর্বে ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি অংশ নিবেন সাদপন্থিরা। গত ১৭ নভেম্বর এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে তাদের মধ্যে চলমান বিবাদ নতুন রূপ পায়।