দেশের জ্বালানি সেক্টরের ‘তেলচোরদের’ ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। ঢাকায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক থেকে তেল চুরিসহ নানা অনিয়ম ঠেকাতে চারদফা সুপারিশ করা হয়েছে। একইসাথে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির কর্মকর্তাদের নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিংয়ের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠক থেকে চুরি ঠেকাতে নজরদারি বৃদ্ধি ও কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের উপরোক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গতকাল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা ও গোদনাইল ডিপোর অপারেশনাল কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি তেল চুরি সংক্রান্ত বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অপারেশন শাখা–১ এর উদ্যোগে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ঢাকাস্থ লিঁয়াঁেজা অফিসে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ এনামুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বিপিসির চেয়ারম্যান (সচিব) মোহাম্মদ আমিন উল আহসান, যুগ্ম সচিব ও পরিচালক (অপারেশন ও পরিবহন) ড. একেএম আজাদুর রহমান, যুগ্ম সচিব হায়াত মোহাম্মদ ফিরোজ, যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরত–ই–ইলাহী বক্তব্য রাখেন।
বৈঠকে ব্যাপক অনিয়ম, তেল চুরি, শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকা, তদারকি ব্যর্থতা এবং অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তেল চুরির কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি, নিরাপত্তা ঘাটতি এবং শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বৈঠকে বলা হয় যে, দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বিভিন্ন গ্রেডের জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল বাজারজাতকরণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে বিপিসি। বিপিসির অধীন তেল বিপণন কোম্পানি যথা পদ্মা অয়েল পিএলসি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে বাজারজাতকরণ সম্পন্ন করে থাকে। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল গ্রহণ, অয়েল ট্যাংকারযোগে ডিপোতে পৌঁছানো বা তেল সরবরাহ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, জ্বালানি তেল পরিবহণে দুইবার লোডিং–আনলোডিং করতে হয়, এতে সিস্টেম লস তৈরি হয়। এছাড়া শ্রমিক সংগঠনের নেতারা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় তারা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। জ্বালানি সেক্টরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের যৌক্তিকতাও তুলে ধরা হয়।
জ্বালানি তেল চুরি রোধে অটোমেশন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন এবং ফ্লো–মিটার স্থাপন সম্পন্ন হলে জ্বালানি তেল চুরি রোধ করা সম্ভব হবে বলেও সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সভায় প্রশ্ন তোলেন যে, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল কোম্পানিসমূহের তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদনে বারংবার বলা হচ্ছে যে, তাদের সিস্টেম লস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাত্রাসীমার ‘পয়েন্ট থ্রি জিরো পারসেন্টের মধ্যেই থাকে মর্মে দাবি করা হচ্ছে। তাহলে তেল চুরির প্রশ্নই থাকে না এবং এই মাত্রাসীমা কি একবারের জন্য নাকি যতবার তেল পরিবহণ ও মজুদের প্রশ্ন থাকবে ততবারই প্রয়োজন পড়বে? এর প্রেক্ষিতে বিপিসির পক্ষ থেকে বলা হয় যে, মোট তিনবার এ ধরণের সিস্টেম লসের হিসাব পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে বলা হয় যে, সিস্টেম লস মোট তিনবারের যোগফলের মাধ্যমে স্বীকৃত সীমারেখার অতিক্রম করে অনেক উর্ধ্বসীমা পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা বিষয়টি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সভায় বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম–ঢাকা জ্বালানি তেল সরবারহ পাইপলাইন চালু হওয়ায় একটি অসাধু চক্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দীর্ঘ আলোচনা শেষে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব তেল চুরি ও সিস্টেম লসের কারণ চিহ্নিত করার নির্দেশনা প্রদান করেন।
সভায় তেল চুরি ঠেকাতে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিবহন) ও যুগ্মসচিবকে আহ্বায়ক এবং সিনিয়র সহকারী সচিবকে (অপারেশন–১ শাখা) সদস্য সচিব এবং বিপিসির অধীন ৩টি তেল বিপণন কোম্পানির ৬জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কমিটি এ বিষয়ে সকল কারিগরি, অপারেশনাল ও লজিস্টিক বিষয়াদি পরীক্ষাপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটিকে জ্বালানি তেল চুরি সংক্রান্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়ন করবে এবং সিস্টেম লস কমানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রতিবেদন দাখিল করবে। খোলা বাজারে অবৈধভাবে জ্বালানি তেল বিক্রয় বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বৃদ্ধি করা হবে এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দৌরাত্ম বন্ধে বিপিসির তেল বিপণন কোম্পানিগুলো নিয়মিত মনিটরিংসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উপরোক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গতকাল জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অপারেশন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মনির হোসেন চৌধুরী, অপারেশন–১ অধিশাখার যুগ্মসচিব একেএম ফজলুল হক এবং অপারেশন–১ শাখার উপসচিব মিয়া মোহাম্মদ কেয়ামউদ্দিন পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোর অপারেশনাল কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে উক্ত কর্মকর্তারা ডিপোর ব্যাপারে বিভিন্ন খোঁজখবর নিয়েছেন। উক্ত তিন কর্মকর্তা তাদের পরিদর্শন রিপোর্ট সচিব বরাবরে জমা দেবেন বলে জানিয়ে বিপিসির একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তেল চুরি ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ের গৃহিত পদক্ষেপ এবং মনিটরিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।












