জ্বর শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় কাহিল শিশুরা

শয্যার তিন-চার গুণ বেশি রোগী চমেক হাসপাতালে

রতন বড়ুয়া | সোমবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

শরৎ চলছে। এই রোদ তোএই বৃষ্টি। যদিও দিনের বেশির ভাগ সময় জুড়েই থাকছে প্রচণ্ড গরম। ঠাণ্ডাগরমের মিশ্র আবহাওয়ার এই সময়ে শিশুদের মাঝে দেখা দিয়েছে উচ্চ মাত্রায় জ্বর (হাই ফেভার), ভাইরাল ফ্লু এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ। শ্বাসকষ্টজনিত রোগের মধ্যে ব্রঙ্কিউলাইটিস, অ্যাজমা ও নিউমোনিয়া অন্যতম। আর এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ তো আছেই। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ভাইরাল ফ্লু ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে শিশুদের যেন কাহিল অবস্থা। এসব রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে যেন ঠাঁই নেই অবস্থা। শয্যা সংকটে এক শয্যায় তিন থেকে চার শিশুকে রেখেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে সব মিলিয়ে শয্যা সংখ্যা একশোর কিছু বেশি। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে বিভাগে ভর্তি শিশু রোগীর সংখ্যা চারশর কম নয়। হিসেবে শয্যার তুলনায় প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি শিশু রোগী ভর্তি থাকছে এই বিভাগে।

এই সময়ে ওয়ার্ডে জ্বর ও শ্বাসকষ্টের শিশু রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে বলে জানান শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম। শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর মধ্যে ব্রঙ্কিউলাইটিস ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি বলেও জানান তিনি। বিভাগে শয্যা সংকটের প্রসঙ্গ তুলে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান বলেন, গরীবঅসহায় পরিবারের শিশু রোগীদের চিকিৎসায় এই হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দূরদূরান্ত থেকে শিশু রোগীদের এখানে নিয়ে আসা হয়। যার কারণে এখানে সবসময় রোগীর চাপ থাকে। এই সময়ে রোগীর চাপ আরো বেড়েছে। শয্যা সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে এক শয্যায় তিন থেকে চার শিশুকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। চাপ সামাল দিতে বিভাগের শয্যা সংখ্যা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম।

বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেনব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট), ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া, সবকয়টি রোগই ভাইরাসজনিত। তবে নিউমোনিয়ার প্রকোপ শিশুদের মাঝে সারা বছর কমবেশি দেখা গেলেও ব্রঙ্কিউলাইটিসের প্রকোপ তেমন থাকে না। কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের সময় আরএসবি (রেসপিরেটরী সিনসেটিয়াল ভাইরাস) ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত এই রোগটির প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে যায়। আর গরমঠাণ্ডায় যোগ হয়েছে ভাইরাল ফ্লু, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ। আর এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। হাসপাতালে আসা শিশু রোগীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শ্বাসকষ্টের জটিলতায় (ব্রঙ্কিউলাইটিসে) ভুগছে জানিয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলেন, অনেকে উচ্চ মাত্রায় জ্বরে (হাই ফেভার) আক্রান্ত। এসব শিশুদের ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে। এই জ্বর ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত ভোগাচ্ছে। ভাইরালজনিত এসব রোগে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই বললেও এ নিয়ে অভিভাবকদের সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সনত কুমার বড়ুয়া।

এদিকে, শ্বাসকষ্টের জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদের নেবুলাইজড করতে হচ্ছে জানিয়ে শিশু আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. ধীমান চৌধুরী বলছেন, ওয়ার্ডে বেশ কয়টি নেবুলাইজার মেশিন রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়দিন ধরে শ্বাসকষ্টের শিশু রোগীর সংখ্যা অত্যধিক হারে বেড়ে গেছে। ৬ ঘণ্টা পরপর শিশু রোগীদের এই নেবুলাইজড করতে হয়। তাই আরো বেশি সংখ্যক নেবুলাইজার মেশিন পেলে রোগীদের জন্য ভালো হয়।

জানতে চাইলে শিশু বিভাগে জরুরি ভাবে বেশ কয়টি নেবুলাইজার মেশিন সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তিনি বলেন, জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্টের রোগী বেড়ে যাওয়ায় আমরা আরো বেশ কয়টি মেশিন ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছেচমেক হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে অন্য সময় দৈনিক ৪ থেকে ৫ জন শিশু ব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট) রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হতো। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিশু ভর্তি হচ্ছে। এর মাঝে জ্বরে আক্রান্ত শিশুও রয়েছে। এছাড়া ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে দৈনিক শতাধিক রোগী শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে ভর্তি হচ্ছে।

শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শিশু ওয়ার্ডের দুটি সাধারণ ইউনিটে মোট ৮৪ শয্যার বিপরীতে তিন শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছে। আর বিশেষ চারটি ইউনিটসহ বিভাগের মোট ১৩২ শয্যার বিপরীতে গত কয়েকদিন ধরে প্রায় পাঁচশ শিশুরোগী চিকিৎসাধীন। শিশু রোগীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও ভরে গেছে বলে জানালেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, চেম্বারেও প্রচুর সংখ্যক রোগী আসছে। বেশির ভাগই জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত। এর মাঝে কিছু রোগীর ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। আর কিছু ভাইরাল ফ্লু। হাতে গোনা কয়েকজন কাশি ও ডায়রিয়া নিয়েও আসছে।

চিকিৎসকের পরামর্শ : শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রায় সবকয়টি রোগই ভাইরাসজনিত কারণে হয়ে থাকে জানিয়ে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তন, ঘর স্যাঁতস্যাঁতেঅপরিস্কার থাকা, ঠাণ্ডাগরমের মিশ্র আবহাওয়া ও ঠাণ্ডাজনিত কারণে শিশুদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া আক্রান্ত শিশুর হাঁচি থেকেও শ্বাসকষ্টজনিত (ব্রঙ্কিউলাইটিস) রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। মূলত এসব কারণেই আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। এ রোগের লক্ষণ হিসেবে হঠাৎ কাশি বেড়ে যাওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া ও জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। আর এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ঘর ও শিশুকে সব সময় পরিস্কারপরিচ্ছন্ন রাখা, শিশুর নাক পরিস্কার রাখা এবং শিশুর শরীরে ঠাণ্ডা লাগতে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের এই চিকিৎসক। তবে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া কিংবা নিউমোনিয়া দেখা দিলে দেরি না করে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর নূর নবীকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মীরসরাইয়ে গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা