গৌরবময় চট্টগ্রামের মহান সন্তান ইতিহাসবিদ ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ কানুনগো পাড়ার অধিবাসী ড. সুনীতিভূষণ স্বগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক ডিগ্রী কোর্স সম্পন্ন করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি ভারতে থেকে যেতে পারতেন। ভারতে স্থান পাবার মত তাঁর মেধা ও যোগ্যতা ছিল। ১৯৪৭ আগে বা পরে এ দেশের প্রচুর মেধাবী ও প্রাজ্ঞ মানুষ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বা নিজেদের উজ্জ্বল ও নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এমনকি তিনি যে কলেজে লেখাপড়া ও অধ্যাপনা করেছেন সে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান একাদশ রত্ন সন্তান ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ভারত রাষ্ট্রের সেবা করেছিলেন কিন্তু অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ সে সুযোগ গ্রহণ না করে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ১৯৪৭ এর আগে বা পরে অনেক দমন নিপীড়ন সত্বেও সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ দেশ ত্যাগ করেননি। এ দেশকে ভালোবেসে এ দেশের সমাজ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন অবস্থায়ও এ দেশে অবস্থান করেছেন, চাকুরী ও ব্যবসা করেছেন। তিনি বীর চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে স্বদেশের সেবা করার জন্য চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন। চট্টগ্রামেও অনেক ভাল চাকুরীতে যোগ দিতে পারতেন কিন্তু তিনি সরাসরি কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ছিল বিশুদ্ধ বিবেকের যথার্থ উপলদ্ধি। তাঁর কাকা অপর এক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. কালিকা রঞ্জন কানুনগোর অনুপ্রেরণায় ইতিহাস অধ্যয়ন ও ইতিহাস চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সাথে এ ব্যাপারে মিল পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক, বিদগ্ধ লেখক ড. আহমদ শরীফের সাথে। ড. আহমদ শরীফ, বাংলা সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল পুরুষ পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভাইপো। চাচার অনুপ্রেরণায় ড. আহমদ শরীফ গবেষণা, শিক্ষকতা ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। সাহিত্যে বিশাল অবদান রাখেন।
ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর গবেষণার বিষয় ছিল Chittagong Under the Muslim rule। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল করিমের অধীনে তিনি গবেষণা কর্ম চালান। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এ গবেষণা কর্ম প্রকাশিত হয়। দেশে ও দেশের বাইরে অনেক ঐতিহাসিক এ গবেষণা কর্মের উচ্চ মূল্যায়ন করেন। ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পাকিস্তানের এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. মাহমুদ হাসান দানী এ গবেষণা গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ড. সুনীতিভূষণকে একটি প্রশংসা পত্র পাঠান। ড. মাহমুদ হাসান দানী পাকিস্তানের একজন প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ। ১৯৭১ এর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি মুসলিম হয়েও ভারতের বারানসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ. করেন এবং ১ম শ্রেণীতে ১ম হয়েছিলেন। তিনি পেশওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ চালু করেছিলেন। পাকিস্তানের সোয়াত ও অন্যান্য জায়গায় প্রত্নতত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে অমূল্য প্রত্নসম্পদ আবিস্কার করেন। বাংলাদেশে থাকা কালে তিনি প্রথম বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্যকলার উপর গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৮৫ সালে সার্ক সম্মেলনে তিনি অতিথি হিসেবে ঢাকায় আসলে সাংবাদিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর তার অভিমত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন A great problem has been solved. ড. সুনীতি কানুনগোর গবেষণা কর্মটি প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অল্প সময় আগে। বাংলাদেশের স্বাধীনের পর পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে তাঁর ডক্টরেট অর্জনের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ পান। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দান করেন। এ ধরনের ঘটনা স্বদেশে ও বিশ্বে চট্টগ্রামের গৌরবকে শীর্ষে তুলে ধরে। এর অনেক পূর্বে একটি ঘটনা ঘটেছিল। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় চট্টগ্রামের লেখক পুঁথি সংগ্রাহক, গবেষক তৎকালে এন্ট্রান্স পাশ (বর্তমান সময়ে এসএসসি পাশ) আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। ভাবতে পারা যায় একজন স্কুল পাশ শিক্ষক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসের পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষক হওয়া।
ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন। গবেষণা কর্ম ছাড়াও অনেক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। লিখেছেন জীবনচরিত। তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের বেশিরভাগ জুড়ে ছিল চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম। লিখেছেন মুসলিম শাসনামলে চট্টগ্রাম, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, চাকমা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম, উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে অনেক গ্রন্থ। তিনি সহজ বোধ্য ভাষায় বাংলাতে ইংল্যান্ডের ইতিহাসও লিখেছিলেন। কানুনগোপাড়া কলেজে ১৯৫০ হতে ১৯৭০ পর্যন্ত যে সব কলেজ বার্ষিকী প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোতে অধ্যাপক সুনীতিভূষণ কানুনগোর অনেক লেখা ছাপা হয়েছিল। সেসব লেখা চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন নিয়ে। বেশীর ভাগ ইংরেজীতে এসব লেখায় মুসলিম সুলতানদের ও সরকারী কর্মকর্তাদের জারী করা আরবী বা ফার্সী ভাষায় লেখা শাহী ফরমানগুলো হুবহু উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা যায় আরবী, ফার্সী ও উর্দূ ভাষায় তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইতিহাস ছাড়াও সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, ধর্মতত্ত্ববিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব সহ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার জ্ঞান কত গভীর তার রচনা পাঠ করলে বুঝতে পারা যায়।
ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর সর্বশেষ রচনা ‘চট্টগ্রামের চারিতাভিধান’। চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের তুলে ধরে চারিতাভিধান রচনা করার কাজ পূর্বে মাহবুবউল আলম, আবদুল হক চৌধুরী সহ বেশ কয়েকজন করেছেন। কিন্তু ড. সুনীতি কানুনগো রচিত জীবনচারিতাভিধান অন্য ধরনের কৃতিত্ব বহন করে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত এ গ্রন্থে তুলে এনেছেন এমন অনেক মানুষের নাম যাদের নাম সময়ের অন্ধকার সুড়ঙ্গে হারিয়ে গেছে। তাদের অনেকের তথ্য তিনি বাংলাদেশের কোন গ্রন্থ, কোন দলিল দস্তাবেজ, কোন আর্কাইভে পাননি।
তিনি ভারতের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বেঙ্গল গেজেট, ভারতীয় আর্কাইভ, ভূমি ব্যবস্থাপনা অফিস, ভূমি বিভাগীয় দপ্তর প্রভৃত্তি থেকে অনেক দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে এসব নাম ও তথ্য তুলে এনেছেন। চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের কোথাও এদের নাম ও তথ্য পাননি যা তিনি পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের অনন্য স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন। লেখকের বংশলতিকায় তার দাদার নাম যা দেশে পাওয়া যায়নি তা তিনি তুলে এনেছেন। লেখক ও লেখকের বংশধর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। বলাকা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও লেখক জামাল উদ্দিন এ গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে জাতির কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন।
ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো একজন আত্মনিবেদিত জ্ঞানসাধক। তাঁর জীবনের শেষদিকে বছর দশেক আগে থাকতে সবধরনের সভা সমিতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কেউ দেখা করতে গেলে বেশী সময় দিতেন না। নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। একটা আত্ম সমাহিত ভাব নিয়ে গৃহে অবস্থান করতেন। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনেক সম্মাননা পত্র, সম্মাননা স্মারক পেয়েছিলেন। তিনি সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারেননি। কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে যেতে অপারগতা প্রকাশ করতেন। অনেক পরে হলেও চট্টগ্রাম একাডেমি ২০২৩সালে শিল্পশৈলী পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছে। এর আগে বা পরে আর কোনো অনুষ্ঠানে তিনি যাননি। এ মহৎ কাজের জন্য চট্টগ্রাম একাডেমির পরিচালনা পরিষদের কর্মকর্তাবৃন্দ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।










