জ্ঞানসাগর দুরবীন শাহ’র একটি গান ও সাধনতত্ত্ব

ইকবাল হায়দার | শনিবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রেমশেল বিধিল বুকে, মরি হায় হায় আমার অন্তরায়, আমার কলিজায়। মারিয়া ভূজঙ্গ তীর, কলিজা করিল চৌচির এমন শিকারি তীর মারিল গো বিষ মাখিয়া তীরের মুখে, মারিল তীর আমার বুকে দেহ থুইয়া প্রাণে মাইরা যায়। প্রথম যৌবনের বেলা, আমারে পাইয়া অবলা প্রেম শিখাইয়া কেন চলে যায় গো জ্বালাইলে যে জ্বলে আগুন, জল দিলে বাড়ে দ্বিগুণ এখন আমি কি করি উপায়। ইট কামেলা ইট বানাইয়া, এক যোগে ভাঁটা সাজাইয়া মাঝখানে আগুন জ্বলাইয়া দিল গো ভেতরে পুড়িয়া সারা, মাটি হইয়া যায় আংগেরা দুর্বীন শাহ কয় এমন দশা আমার বেলায়।’ এ গানে দুরবীন শাহ মূলতঃ জগত স্রষ্টার মাহাত্ম্যকে, তার সৃষ্টির বিস্ময়কর অসাধারণত্ব ও তার রহস্যময় অবস্থান, চিত্তাকর্ষক, অনুপম শব্দের গাঁথুনীতে, বাক্যের ব্যবহারে, নান্দনিক ছন্দে, কাব্যিক রূপে বিধৃত করেছেন তার সাধন প্রক্রিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে। এই গানের গূঢ় মর্ম আমাদের অনুধাবনে নিম্নরূপ, শুরুতেই ছয় লাইনে তাঁর ব্যাখ্যা এ রকম, মহা বিশ্বের এত রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, শব্দ, স্পর্শ, প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর শতরূপ, কখনো রোমাঞ্চকর, কখনো ভয়ংকর প্রাণঘাতী খেলা, অপরূপ ঋতুর আবর্তন, পরিবর্তন, বিবর্তন। দিন, ক্ষণ, মাস, বছর পেরিয়ে কী সুন্দর আবার স্বকীয় নিয়মে ফিরে আসে! এ আকাশ, বাতাস, নদী, জল, সব নিয়মেই প্রবাহিত, চলমান ঘূর্ণায়মান। এখানে মানবের প্রেম, হাসি, দুঃখ, কান্না, বেদনা, আর্তি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অভাব, ঘৃণা, রঙ, বর্ণ, জাত, পাত, সকল সৃষ্টি তারই কিন্তু সে যে অধরা। জন্ম, মৃত্যু, বৃদ্ধি, ক্ষয়, তারই নিয়ন্ত্রণে। কেউ আসে কেউ যায় অস্থির এ পৃথিবীর প্রাণ, প্রাণীর উন্মেষ, বৃদ্ধি, ক্ষয়, প্রেম, প্রীতি, দ্বন্দ্ব সব যে তারই খেলা। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে তারই আরাধনা, প্রার্থনা, কীর্তন, কীর্তি। না জানি কী সুন্দর, সে? কী অপরূপ তার অবয়ব? তার সৃষ্টিই প্রেম আবিষ্ট করে প্রতিটি প্রাণে, অন্তরে, এ যেন সেই প্রেম শেল, অন্তরে যা বিঁধেছে। সেই অধরার দর্শনে, তারই মিলনে, তার প্রাপ্তির কারণে অহরহ ব্যতিব্যস্ত লেখক বাউল দুরবীন শাহ। সে অধরার দর্শনে, সাক্ষাতের কারণে হৃদয়, মন এতই কাতর যে বিষধর সর্পের হলাহল সম তীর যেন ছুড়েছে অধরার দর্শনার্থীর এ প্রাণে। যার আঘাতে এ কলিজা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। সে প্রেমশেল এমনি যা দেহকে স্পর্শ না করে সরাসরি প্রাণে এসে লেগেছে। সে এমনি প্রেমশেল যাতে মিশে আছে প্রেমের অমিয় গরল। দ্বিতীয় অন্তরায় সাধক প্রথম যৌবনের যে রূপ, মাধুরী, শিহরণ, চাঞ্চল্য, আবেগ, অনুভূতিতে উচ্ছল নব জীবন সে সময় অধর তার যাবতীয় রূপ সামগ্রী আড়াল করে নিঠুরের মত পালিয়ে থাকে দূরে ছোঁয়ার, স্পর্শের বাইরে, নিরঞ্জনে, বিপরীতে হৃদয়ে মনে দেহে জ্বলেছে আগুন দেখা না দিয়ে। অন্যে কি তা বোঝে? সে তো অপ্রেমিকের বোধগম্য নয়। সে আগুন কে নিভাবে অধর ওই বিনা? এখন তার দরশন ভীষণ প্রয়োজন। কী উপায়ে পাব তারে, কোন সে সাধনে? শেষ অন্তরায় সে জগদীশ্বর, সৃষ্টিকর্তা ইট কামেলার মত যেমন ইট ভাঁটায় আগুন লাগিয়ে কয়লা, কাঠ, মাটি পুড়িয়ে ইট বানায় তেমনি সাধক দুরবীন শাহের হৃদয়, মন অন্তরে প্রেমের আগুন জ্বলে পুড়িয়ে অংগার করে দিল। সব সাধকের ব্যতিক্রম নয় এ সাধক দুরবীন শাহও। তবে মরমীয়া সাধক, পদাবলির গুরু তত্ত্ববিদ, বাউল দর্শন পরিপূর্ণ পদাবলী রচয়িতা, শ্রেষ্ঠ পদকর্তা দুরবীন শাহ আছে দেহতত্ত্বের বাউল দর্শনের গুহ্য ও নিগূঢ় বিষয়াবলী, কোরান, পূরাণ, শরীয়ত, মারফত দেহের নানা পরিপাকতন্ত্র ও রেচন প্রক্রিয়াকে গানের মধ্যে উপস্থাপন করেছে নিপূণভাবে। তাঁর বিচ্ছেদি ঘরানার গানগুলির ভাবার্থ এবং দ্যোতনা শ্রোতাদের কাছে গভীর আবেদন সৃষ্টি করে। তার বাউল, বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক, গণসংগীত, মালজোড়, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, গোষ্ঠ, মিলন, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী, ভক্তিগীতি, মনঃশিক্ষা, সুফিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, পাথরঘাটাতত্ত্ব, দেশের গান সহ আরো অনেক। ১৯৭৪ সালে কোলকাতার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তার ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পোচলচ্চিত্রে দুরবীন শাহের লেখা ‘নামাজ আমার হইলনা আদায়’ গানটি দুরবীন শাহের কণ্ঠেই ব্যবহার করলে ছবি মুক্তির পর পরই দুরবীন শাহের পরিচিতি জন সমক্ষে প্রকাশ পায়, পায় জনপ্রিয়তা। আমার দ্বিতীয় এলবাম সাউন্ডটেক প্রযোজিত’ চিঠি দিও দিও পত্র দিও’ তে প্রথম এ গান ব্যবহার করে প্রচুর জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি পাই। মানুষের মুখে মুখে গীত হয় এ গান তার নতুন কথা, ভাবার্থ, সুর ও মায়াময় শব্দের কারণে। অনেকে দুরবীন শাহের রচনাবলির সংগে লালন শাহের পদাবলির তত্ত্বগত সাযুজ্য খুঁজে পান। লালনের মাধ্যমেই বাউল গান এত বিস্তৃতি পেয়েছে বিশ্বময়। তাঁর প্রভাবেই উভয় বাংলার বিবিধ অঞ্চলে বাউল গানের জনপ্রিয়তা, শ্রোতা ও মানুষের কাছে বাউল গানের সুস্পষ্ট ধারা দারুন বেগবান হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় দুরবীন শাহের গানে দেহতেত্ত্বর ও বাউল দর্শনের গুহ্য ও নিগূঢ় বিষয়গুলি সুন্দরভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে বোদ্ধা শ্রোতা ও সংগীত পিপাসুদের কাছে। যেমনঃ তিনি বলেন, ‘ঘর বানাইলরে মালীক মেস্তরী ঘরের ভিতর রইয়া করে লুকোচুরি’ বা ‘আজব রঙের কল বসাইল মানুষের দেহায় সেই কলের নাম হইল সুগার মিল দেখবি যদি শীঘ্র আয়’। তার রচনার অভ্যন্তরে আছে নানা সাংকেতিক ভাষা ও বাউল তত্ত্বের নানা গোপন বিষয়ের ইশারা। তার গানে আধ্যাত্মবাদী শব্দের আড়ালে বস্তুবাদী চেতনার প্রকাশ পেয়েছে আবার কখনো সমন্বয়বাদী চেতনার উৎসও রয়েছে। যেমন, ‘বাবার টাকায় শ্রাদ্ধ করি কিনে চশমা স্যুট আর ঘড়ি সারশূণ্য বাবুগিরি বেশীদিন টেকেনাসাম্যবাদ, বাউলতত্ব, দেহতত্ত্‌ব যেমন উত্থাপিত হয়েছে তার গানে তেমনি অনেক বিচ্ছেদ গানও তিনি রচনা করেছেন। যেমন, ‘আমি যদি যাই মরিয়া রে ও বন্ধু তোর প্রেম শেল লইয়া তোর নামের কলংক রবে জগত জুড়িয়া বন্ধু রে’ বা বন্ধু রইল দূরদেশে, আমি কাঁদি আশার আশে। সে আশা মোর আর কবে মিটিব আসবে বলে প্রাণ কালা, বিনা সুতে গাঁথি মালা মালা বাসি হলে কার গলে পরাব। মানুষের বোধ ও আবেগের কাছাকাছি আসতে পেরেছে বলেই নর নারীর প্রেম বিরহ আবেগ ভালবাসা দুরবীন শাহের লেখায় নতুন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, ‘পিরিতি কি গাছের গোটা জীয়ন্তে হইয়াছী মরা যার লাগল প্রেম লেঠা’। আবার তার লেখা ও ভাবনায় পৌরানিক বিষয় এসেছে দারুণভাবে। যেমন– ‘পরম শীব পরমাত্মা ব্রহ্মাণ্ড যাহার সত্তা জীব শীব জীবাত্মা ভিন্ন মূর্তি তাতে’। তার রচনায় বারোমাস্যা গানও আছে। স্বরূপ অন্বেষণ বাউল সাধকের মূল বিষয়। নিজের ভেতর তার সন্ধানে তাই বাউলরা ব্যস্ত থাকেন। তেমনি দুরবীন শাহের লেখার বাউলিয়ানার আঙ্গিক দৃষ্ট হয়। শরীয়ত, মারফেতেরও সমান ব্যবহার দেখি তার গানে। লালন সাঁইজী যাকে বলেন মনের মানুষ যা পরম গুরু ও একজন বাউলের আরাধ্য, যার চরণ পাওয়ার পরম আশায় নিরন্তর শিষ্যের আরাধনা চলতেই থাকে দুরবীন শাহের লেখায় গানে এর ব্যতিক্রম নেই কোথাও। তার গানে প্রভু, নিরঞ্জন, গুরু সহ অসাম্প্রদায়িক ভাবের ব্যপ্তিতেও চলে আসে গণচেতনার বিষয়টি তার লেখায়। যেমন, ‘কেন ঘুম ভাঙে না মোদের কেন ঘুম ভাঙে না জাগো জাগো বাঙালি ভাই নিদ্রায় রইলে আর চলে না’। আবুল আহসান চৌধুরী ‘দুরবীন শাহ মূল্যায়ন’ সম্পর্কিত এক লেখায় বলেছেন, ‘বৌদ্ধ সাহজিয়ার করণকারণ, সুফীমত আর বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের সঙ্গে দেশজ লৌকিক সাধনার ধারা মিশে যে মরমী প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এই অঞ্চলে, তা মূলত প্রকাশ পেয়েছে সংগীতের মাধ্যমে। দীন ভবানন্দ, সৈয়দ শাহ নুর, শীতালং শাহ, কালা শাহ, দৈখোরা (মুনীরউদ্দীন), রাধারমন, দীনশরৎ, আরকুম শাহ, আব্দুল লতিফ, শেখ ভানু, দীনহীন, হাছন রাজা, সহীফা বাণু, সৈয়দ আসহর আলী চৌধুরী, দেওয়ান একলিমুর রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রকিব শাহএই সব মরমী মহাজন তাঁদের সংগীতের সুবাদে যে মরমী ভুবন নির্মাণ করছেন, সেই উত্তরাধিকারের ধারায় দুরবীন শাহের নামের উল্লেখও অপরিহার্য। জ্ঞান সাগর দুরবীন শাহ, মরমী গীতিকবি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার এ বাউল সাধকের জন্ম ১৯২০ সালের ২ নভেম্বর নোয়াবাই, ছাতক, সুনামগঞ্জের তারামনি টিলায়। পিতা সাফাত আলী শাহ ছিলেন একজন সুফী সাধক। মা হাসিনা বাণুপিরাণী। ১৯৪৬ সালে সুরফা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ জ্ঞান সাগর, সাধক কবি ১৯৭৭ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ৩ ফাল্গুন ১৩৮৩ বংগাব্দে দেহত্যাগ করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় স্বাধীনতা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে