অপরাধীদের সংশোধন করতেই কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে এক মামলায় শাস্তি ভোগ করতে গিয়ে বের হয়ে আরো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। নগরীতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন অপরাধী ধরা পড়েছে নগরীর বিভিন্ন থানায়, যারা অপরাধ করে জেলে গেছে, ফিরে এসে আবারো একই কিংবা আরো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। নামের পাশে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে আবার ধরা পড়ার পর দম্ভ করে বলছে, জেলে যতবার গেছে ততবার নিজের শ্বশুর বাড়িতেও যায়নি।
মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান চলাকালে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর পাথরঘাটা, ব্রিকফিল্ড রোড বাই লেনের একটি বাসা থেকে সাইফুল আলম (৩৫) নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পরে তার থেকে ৮ হাজার পিস ইয়াবা এবং ইয়াবা বিক্রির ১৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। অভিযান পরিচালনাকারী কোতোয়ালী থানার এসআই মোমিনুল আজাদীকে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত চারটি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে।
একটি চুরির মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সাড়ে তিন মাস পর কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে একটি চক্র, যারা জেলে গিয়েছিল বিভিন্ন অপরাধ করে, বের হয়ে করেছে সম্মিলিত অপরাধ। তাদের একজন সুমন ধর; স্ত্রী নির্যাতনের মামলায় কারাভোগ করেছিলেন, সেখানে পরিচয় হয় তিন সিঁধেল চোরের সঙ্গে। কারাগারে বসেই তারা পরিকল্পনা করে স্বর্ণ চুরির। কিছু দিন পর জামিন হলে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে তারা। গত বছরের ১ অক্টোবর নগরীর ফিরিঙ্গী বাজার জেএম সেন স্কুল গলির একটি ভবনে চুরি করে ৩৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায় তারা চারজন। কোতোয়ালী থানা পুলিশ একে একে চারজনকে গ্রেপ্তার করে এবং উদ্ধার করে ৩২ ভরি গলানো স্বর্ণ। কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, আজিজ ও বশর পেশাদার চোর। ২০১৮ সালে তারা দুজন এবং তাদের সহযোগী ওসমান চুরির মামলায় কারাগারে যান। ওই সময়ে স্ত্রীর করা নারী নির্যাতনের মামলায় কারাগারে ছিলেন সুমন ধর। কারাগারে পরিচয়ের সূত্র ধরে সুমন ধর তাদের চুরি করা মালামাল কিনে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। পরে সবাই কারাগার থেকে জামিনে বের হলে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। এসময় সুমন তাদের টাকা দিত এবং স্বর্ণ চুরির জন্য নিয়মিত প্রলুব্ধ করত।
নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের ইলেক্ট্রনিঙ পণ্যের ব্যবসার আড়ালে চালিয়ে আসছিল ইয়াবার ব্যবসা। রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার লেনে এসএন ইসলাম মার্কেটে ‘তৌহিদ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ইলেক্ট্রনিঙ আইটেমের দোকানের মালিক আব্দুল করিম। ইয়াবা সরবরাহ করেন ঢাকা-ময়মনসিংহ সহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। ২০ ফেব্রুয়ারি ভোরে নগরীর কোতোয়ালী থানার নিউ মার্কেট মোড় সংলগ্ন ফুলকলির সামনে থেকে ৩৫০ পিস ইয়াবাসহ করিমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওসি কোতোয়ালী নেজাম উদ্দিন জানান, আব্দুল করিম ও তার ভাই আব্দুল খালেক- দু’জনের রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমণ্ডি লেনে ইলেক্ট্রনিঙ আইটেমের দোকান ছিল। মূলত তারা ওই দোকানের আড়ালে ইয়াবার ব্যবসা করত। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই আব্দুল করিমকে সাউন্ডবঙের ভেতরে ৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ নগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। জামিনে বেরিয়ে আব্দুল করিম নতুন দোকান খুলেন। এরপর আব্দুল খালেকও ১১ হাজার ৭৭৫ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন। খালেক এখনও জেলে আছেন।
ডবলমুরিং থানা পুলিশ গত ১১ ফেব্রুয়ারি একটি চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা পকেট কাটে, ছিনতাই করে, করে ডাকাতিও। থাকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু সিন্ডিকেট হিসেবেই তারা কাজ করে। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর শেখ মুজিব রোড থেকে ধরা পড়ে তারা। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, এ টিমের অপরাধ জীবন দীর্ঘদিনের। ধরা পড়ে, বের হয়ে আবারো একই কাজ করে। চক্রের দলনেতা তাজুল প্রায় দেড় যুগ ধরে নগরীতে ছিনতাই করে আসছে। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ছিনতাইয়ের মামলা আছে কমপক্ষে ২০টি। গ্রেপ্তারও হয়েছে ২০ বার। তার স্বীকারোক্তি হলো যে, ‘স্যার নিজের শ্বশুর বাড়িতে অতবার যাই নাই, লাল দালানের শ্বশুর বাড়িতে (কারাগার) যতবার গেছি’। বারবার জামিনে বেরিয়ে সে ছিনতাইকারী চক্র গড়ে তোলে। গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের বিরুদ্ধেও কমপক্ষে ৫টি করে ছিনতাইয়ের মামলা আছে।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কোতোয়ালী থানা পুলিশ রতন দাশ নামে ২৩ বছর বয়সী অভিনব এক চোরকে গ্রেপ্তার করে, রাত দুইটার দিকে যে চুরি করতে বের হয়। পাঁচ তলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত সে তরতর করে উঠে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকারসহ যা পায়; নিয়ে নেমে আসে ভোরের আজান দেয়ার আগে। কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, দুই বছর জেল খেটে বের হয়ে দুই সপ্তাহও হয় নি, সে আবারো গ্রেপ্তার হয়েছে কোতোয়ালী পুলিশের হাতে চুরির অপরাধে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সে অসংখ্য চুরি করলেও দুইটি মামলা ছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা হয় নি। ২২ জানুয়ারি নগরীর স্টেশন রোড এলাকার একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দুর্ধর্ষ এক চোর সুনামগঞ্জের শফিকুল ইসলাম ওরফে শইক্যাকে। সে এ পর্যন্ত ৪১ জেলায় চুরি করেছে। ধরা পড়ার পর পুলিশকে জানিয়েছে, ২০১৮ সালে হাটহাজারী থেকে স্বর্ণ ও টাকা চুরি করে চট্টগ্রাম আসার সময় আকবরশাহ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বের হয়ে ভেবেছিল ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু মামলার হাজিরা দেওয়ার টাকা যোগাড় করতে কষ্ট হতো। তা ছাড়া ততদিনে ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়েছিল। এসব কারণে আবারো চুরি করতে শুরু করে।
সাতবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটতে হয়েছে মো. শুক্কুরকে (৩২)। ছিনতাইয়ের অভিযোগেই প্রতিবার ধরা পড়ে সে। গত ১৬ জানুয়ারি সকালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাতে আবারো মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে শুক্কুর কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে। তার বিরুদ্ধেও অস্ত্র ও মাদকদ্রব্যসহ নানা অপরাধে মামলার সংখ্যা বর্তমানে সাতটি।