জেলহত্যা দিবস আজ

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

জুলিয়াস সিজারকে শেষ পর্যন্ত বন্ধু, সহকর্মী ব্রুটাস যখন অসি দিয়ে আঘাত করেছিল তিনি বলেছিলেন “Thou too Brutus!”। মোহাম্মদী বেগ ছোটবেলায় নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে একই মায়ের দুধ পান করেছিলেন।এই নবাব সিরাজুদ্দৌলাকেই পিছন থেকে ছুড়ি মেরে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ। নবাব মৃত্যুর আগে শুধু বলেছিলেন ‘মোহাম্মদী বেগ তুমি?’ বাংলাদেশের ইতিহাসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। সুরক্ষিত কারাগার অরক্ষিত হয়ে রক্তাক্ত হয়েছিল। এইভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে স্বাধীন দেশে যার শুরু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট।
“২/৩ নভেম্বর গভীর রাতে সবার অজান্তে সংঘটিত হলো এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল গাড়ি করে সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছায়। তারা ভিতরে ঢুকে অন্তরীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে চায়। জেলার হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি সশস্ত্র ব্যক্তিদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। এনিয়ে তার সঙ্গে ঘাতকদলের অনেকক্ষন কথা কাটাকাটি হলো। তারা জোর করে ঢুকে যেতে চাচ্ছিল। কারাগারে পাগলা ঘন্টা বেজে উঠলো। ডি আই জি ও আই জি (প্রিজন) গেটে ছুটে আসলেন।
জেল গেট থেকে আই জি ( প্রিজন) সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেম উদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজিঃ খোদ প্রেসিডেন্ট বেয়াইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি / ডি আইজি কি করতে পারে? প্রেসিডেন্ট এর নির্দেশে মোসলেম উদ্দিন ও তার ঘাতক দলকে জেলের ভিতর প্রবেশ করতে দেয়া হয়। আইজি এবং ডি আইজি তাদের পিছন পিছন অনুসরণ করেন।এসময় মোসলেম উদ্দিনকে ভয়ংকর দেখাচ্ছিল, সম্ভবত সে মাতাল ছিল।
তাজউদ্দীন এবং নজরুল ইসলাম ১ নং সেলে ছিলেন। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। তাদেরকে তাজউদ্দীনের সেলে এনে জড়ো করা হয়। ঘাতক মোসলেম উদ্দিন খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করেন। তাদের মধ্যে তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। তাজউদ্দীনের পায়ে ও হাঁটুতে গুলি লাগে, প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে মারা যান। পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিলেন। কিন্ত ভীত বিহবল পরিবেশে কেউ একফোঁটা পানি এগিয়ে দিতেও সাহস পাননি। পাশের সেলে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তার নাম লিস্টে না থাকায় ঘাতকরা তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি বেঁচে যান। এর কিছুক্ষণ পর নায়েক আলীর নেতৃত্বে একটি ইউনিফর্ম পরা ঘাতকদল আসে এবং মৃত চার নেতার উপর বেয়নেট চার্জ করে এবং দ্বিতীয় দফা গুলিবর্ষণ করে। লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এম এ হামিদ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা গ্রন্থে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর জেল হত্যাকাণ্ডের কথা এভাবেই তুলে ধরেছেন। কারাগারের অভ্যন্তরে ইতিপূর্বে এই ধরনের নির্মম ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এর একমাত্র কারণ মনে করা হয় খোন্দকার মোশতাক এর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এই চার জাতীয় নেতা। দ্বিতীয়ত এই চারজন বঙ্গবন্ধুর এতোই আস্থাভাজন ছিলেন যে এদের ভয়ে ভীত ছিল মোশতাক। কেননা এই চারজনকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিতে এবং সফল হতে দেখেছিল মোশতাক।
সেইরাতে রুমের মধ্যে চারজনকে এক করা দেখেই মুক্তিযুদ্ধকালীন ধীমান প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন কি ঘটতে যাচ্ছে। তিনি তার তিন সঙ্গীকে বলেন ‘সময় নাই অজু করে আসেন’। তিনি নিজেও অজু করে নামাজ পড়েন পানি খান। এরপর চারজন সৈয়দ নজরুলের চৌকির উপর বসেন। রুমে বাইরের বলতে শুধু ছিলেন কেবল জেল সুবেদার আবদুর রশীদ মৃধা। আইজি ও ডি আইজি ছিলেন ওয়ার্ডের সামান্য দূরে। চারজনকে একরুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে মোসলেম ও তার সঙ্গীরা সেলে গিয়ে ঢোকেন।সঙ্গে জেলার আমিনুর। তাজউদ্দীন কঠিন কন্ঠে জোরে বলেছিলেন ‘হোয়াট ইউ আর ডুয়িং’? তারপরই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কেঁপে উঠে ব্রাশ ফায়ারের ভয়াল শব্দে। গুলিতে ছাদের টিন, মেঝে ঝাঝড়া হয়ে যায়। এরপর নেমে আসে ভয়াল নীরবতা। কিছুপর সেই নীরবতা ভেঙে চকবাজারের বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান। লাশগুলো অবহেলায় সেলের মধ্যে পড়েছিল পরদিন দুপুর অবধি। সন্ধ্যার আগে ঠিক করা হয় জেলে নিয়মরক্ষার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এর। এরপর লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় প্রত্যেকের বাসায়।
‘এখনো যায়নি আঁধার এখনো অনেক ফাঁকি’ এই নিবন্ধে ইমতিয়ার শামীম লিখেছেন ‘ঢাকার ছাত্ররা অনেক চেষ্টা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে চার নেতাকে সমাহিত করতে। টিএসসির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরটির পাশে কবর ও খোড়া হয়। একথা ছড়িয়ে পড়লে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বনানী কবরস্থানে কবর দেয়ার চেষ্টা করে। সবাই এর প্রতিবাদ করেন। মিছিল হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের চেষ্টা সফল হয় না। জেল হত্যাকাণ্ডের রায় হয় হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২৯ বছর পর। সাবেক বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আনিসুল হক রায়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে অভিহিত করেন। (প্রথম আলো ২১ অক্টোবর ২০০৪)। হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ পালনকারীদের শাস্তি হলো ষড়যন্ত্রকারী বা নির্দেশদাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। শহীদ তাজউদ্দীন কন্যা ১৯৮৪ সালে ‘সচিত্র সন্ধানী’ তে লিখেছিলেন ‘৩ রা নভেম্বর : বাবাকে মনে করে’ কবিতায় :
” বাড়িতে যখন অতিথি এলো
কর্তার খোঁজ পড়লনা।
হৈ চৈ আর হাস্য লাস্যের মধ্যে
নতুন অতিথির হলো বন্দনা।
তখনো খোঁজ নেই কর্তার
দিঘির পাষাণ ঘাট নিঃশব্দ
কোন পদশব্দে আর চমকেও উঠলোনা……..”
কন্যার কাছে পিতাকে হারানোর আকুতি থাকবেই। কিন্ত জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ে অবিচল আস্থায় “দুর্গম গিরি কান্তার পথ” পাড়ি দিয়েছিলেন। ‘স্বাধীনতা’ নামের অবিনাশী শব্দ তুলে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মানুষকে। ইতিহাসের পাতায় কর্মে ও আদর্শে তাঁরা চিরঞ্জীব, মৃত্যুহীন প্রাণ যদিও ” দিঘির পাষাণ ঘাট নিঃশব্দ” আজ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর প্রার্থীরা কে কত ভোট পেলেন