জেনেসিস

জীবনের উৎস অনুসন্ধানের চিত্রকাব্য

শৈবাল চৌধুরী | সোমবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

২য় ও শেষ পর্ব

মার্কিন নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার জর্জ সিটন বলেছিলেন, ‘গল্প তো আছে মাত্র তিনটি, মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ, সমাজের বিরুদ্ধে মানুষ আর নিজের বিরুদ্ধে মানুষ।’ (প্রসঙ্গ মৃণাল সেনচলচ্চিত্র সমালোচনা, সম্পাদনা বিভাস মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ক্রম ৩২৫)

মৃণাল সেনের ‘জেনেসিস’ (গল্পসমরেশ বসুর ‘উরাতিয়া’) ছবিতে এই তিনটি গল্পই আছে। বিস্তৃত এক খরাপ্রবণ মরুপ্রান্তর। পানি কিংবা বৃষ্টির অভাবে মাটি ফেটে চৌচির। এই দৃশ্য দিয়েই ছবির শুরু। তারপর এক জোড়া রাজসিক পায়ের পদচারণায় দৃশ্য। পরের দৃশ্যে দেখা যায় দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের সাদা কাগজে খত দিয়ে যৎসামান্য ঋণ গ্রহণের দীর্ঘ সারি। তিনটি দৃশ্যের সমন্বয়ে অনবদ্য এক মন্তাজের মধ্য দিয়ে ছবিটি শুরু হয়। আর আমরা বুঝে যাই, খারাপীড়িত কোনো অঞ্চলে সর্বহারা মানুষের জায়গা জমি খতের মাধ্যমে যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে কোনো জোতদার আত্মসাৎ করে নিচ্ছে বরাবরের মতো, যুগে যুগে যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া চলমান।

ঋণ সংগ্রহের পর নিঃস্ব দুই চাষি ও তাঁতি নিজ নিজ পেশায় প্রবৃত্ত হয়। রুখু প্রান্তরে অমানুষিক শ্রমে জমি কর্ষণের আপ্রাণ চেষ্টা চাষির। আর হতশ্রী তাঁতে বুননে মনোনিবেশ করে তাঁতি। দু’জনের মধ্যে চাষি সহজ সরল, তাঁতি কিছুটা বুদ্ধিমান। চাষির অবিরাম বর্ষণে উঠে আসে এক কঙ্কালের খুলি। ভগ্ন ঝুপড়িতে আনার পর বিস্ময়াহত দু’জন এক পর্যায়ে খুলিটিকে আছড়ে ফেললে বিদ্যুৎচমকের মতো এক উড়োজাহাজের শব্দ শোনা যায় আকাশে এবং এর কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে অসহায় ও বিপর্যস্ত এক নারীর আগমন ঘটে। অনেক পরে জানা যায়, প্রলয়ংকরী বন্যায় সে তার স্বামী সন্তান সবাইকে হারিয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছে এই ভগ্নস্তুপে। ভগ্নস্তুপটি হয়তো কোনো পরিত্যক্ত প্রাসাদ। হয়তো কখনও সেখানে কোনো এক সময় ছিল কোলাহলপূর্ণ জনপদ যা এখন পরিত্যক্ত। তবুও সেখানে দুই শ্রমজীবী মানুষকে ঘিরে ছিল জীবনের ন্যূনতম স্পন্দন। অনাহুত নারীকে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষের আশ্রয় দেয় পুরুষদ্বয়। নারীকে কেন্দ্র করে তারা নতুন উৎসাহে নিয়োজিত হয় নিজেদের কাজে। নারীটি ফসলেরউর্বরতার প্রতীক হয়ে যেন আসে তাদের জীবনে। তিনজনের যুথ শ্রমে ফলে প্রচুর সব, উৎপন্ন হয় বর্ণিল নকশার অনেক কম্বল। সেই ধূর্ত বণিক সেও খুব উৎফুল্ল হয়। এই উৎপাদনের বহরে যেখানে রয়েছে তার অপার মুনাফার সুযোগ, যে উৎপন্ন শস্য ও বস্ত্র সে নামমাত্র মূল্যে কৃষক ও তাঁতির কাছ থেকে নেয় তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের বিনিময়ে, দুই শ্রমিক তার কাছে শৃঙ্খলিত শ্রমদাসে পরিণত, তার তীব্র লোভে এই ভগ্নস্তুপের প্রতিও যেখানে সে হয়তো দেখে নতুন কোনো জনপদ গড়ার কিংবা খনিজ আহরণের লোলুপ স্বপ্ন।

নারী ক্রমশ সংসারেও মন দেয়, গুছিয়ে তোলে সামান্য গৃহপরিসর। প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মে নারীটির আবর্তনে গড়ে ওঠে গোপন ত্রিভুজ সম্পর্ক যা দুই পুরুষের পরস্পরের অগোচরে থাকে। ক্ষেতের ফসলের পাশাপাশি নারীও অন্তসত্ত্বা হয। কিন্তু পিতৃত্বের দাবিতে তিনজনের মধ্যে ঘনীভূত হয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস। এর আগে তারা দুয়েকবার বাজারে গিয়ে বণিকের বিরাগভাজন হয়। বণিকের সন্দেহ ছিল তারা বাজারে পণ্যের দর যাচাই করতে গেছে। যদিও তারা বাজারে যায় বিনোদনের ছলে এবং প্রণয়াসক্ত নারীর জন্যে উপহার কিনতে। বণিক তাদের উপর রুষ্ট ছিল নারীটির আগমনের পর থেকে। অবশ্য পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পর বণিক নারীটিকে মেনে নিলেও সে জানতো অন্য কিছু একটা ঘটবে এবং তাই নিয়ে তাঁতি ও চাষির মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হলে সে তখন সেই সুযোগটা কাজে লাগাবে। কার্যত হলোও তাই। দুই বন্ধুর মধ্যে পিতৃত্বের দাবি নিয়ে উদ্ভুত সংঘর্ষের এক পর্যায়ে প্রশ্নবিদ্ধ নারী উধাও হয়ে যায়। এর আগে তাঁতি ও চাষির জেরার উত্তরে সে জানায় তার গর্ভস্থ সন্তানের জনক কে সে তা নিশ্চিত জানে না এবং এ নিয়ে বিতর্কেরও কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ সন্তানটি তার, সে তার জননী। সাংঘাতিক এক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ও প্রকাশ। প্রাচীন অনেক পুরাণের ও ইতিহাসেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। নারী এখানে উর্বরতা ও জননের প্রতীক যা এ ছবিতে আমরা দেখি শস্য ও শিশুর জন্মের মধ্য দিয়ে। তেমনিভাবে চারটি চরিত্র যেন পুরো পৃথিবী; যেখানে রয়েছে সব ইন্দ্রিয়ের সন্নিবেশ’ ক্ষুধা, লোভ, শোষন, শাসন, হিংসা, প্রেম, ঈর্ষা, বিভেদ, সম্ভোগ, সন্দেহ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, প্রতিহিংসা, লুণ্ঠন, জবরদখল, উপনিবেশ সৃষ্টিসবকিছুই দেখি আমরা ঐ ভগ্নস্তুপের অঙ্গন জুড়ে। বণিকের চরিত্রটি যেন বাজার অর্থনীতির ও অনৈতিক মুনাফার প্রতিভু।

নারীটি চলে যাওয়ার পর লড়াইরত দুই পুরুষের মধ্যে যখন ঐক্যে ফাটল ধরে সে সুযোগ বণিক তার পোষা বাহিনী নিয়ে উদয় হয় এবং চাষী ও তাঁতীকে বন্দী করে ভগ্নস্তুপটি ও ক্ষেতজমিসহ বিশাল প্রান্তর জবরদখল করে এবং বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। হয়তো সেখানে গড়ে উঠবে সুরম্য জনপদ কিংবা কলকারখানা কিংবা চলবে খনিজ অনুসন্ধান। ধেয়ে আসে বিশাল সব বুলডোজার।

জেনেসিস প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত বলেছিলেন, জেনেসিস মৃণাল সেনের সগর্ব প্রত্যাবর্তন সমাজবিবর্তনের মূলস্রোতে সমরেশ বসুর মূল কাহিনীর খোলস পালটে সর্বহারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ ছবি। সত্যিজিৎ রায়ের সদগতির ধারায়। সর্বহারা বলেই ওদের আবেগ প্রকাশ এত নগ্ন, এত বলিষ্ট, এত প্রকট। ঈর্ষাতাড়িত দুই পুরুষ এক প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের ধূলিময় রাজপথে হিংস্র মল্লযুদ্ধে পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এই আদিমতা অসম্ভব হত মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাটে।

স্পষ্টই বোঝা যায় কাহিনীটিকে মৃণাল বাবু দিতে চেয়েছেন এক আদিম সংঘর্ষের মাত্রা। যা কোলাহলময় গ্রাম্য জীবনে হারিয়ে যেতো। তাঁতি ও কৃষকের জীবনযাত্রায় ফুটে উঠছে আদিম মানব সমাজের শ্রম বিভাগ ও সবিশ্বাস সহযোগিতা, যেখানে লোভের হাত বাড়িয়েছে বাণিজ্য। উঠের পিঠে চড়ে আসে এক ব্যবসায়ী, সূতো জোগায় তাঁতিকে, তেলনুনআটা দিয়ে যায় নিয়মিত। পরিবর্তে সে তাঁতির হাতে বোনা কম্বলাদি নিয়ে চলে যায় হাটে বেচবে বলে। একদিন তাঁতি ও চাষি বুঝলো, নিজেদের জন্যে একটা গামছা বুনবার অধিকারও তাদের নেই। তাদের শ্রমশক্তি সম্পূর্ণ বিক্রিত। বণিক, তাঁতি ও চাষিএই তিন প্রতিরূপ স্থানীয় চরিত্রের মধ্যে গল্পের ছকটা সুদৃঢ়ভাবে আবদ্ধ বলেই চধৎধনষব এর আমেজ পাওয়া যায়। রূপকথার তীক্ষ্ণ সারল্য অনুভব করা যায়। একটি জটিল ঐতিহাসিক যুগের সারাংশ চিত্রিত হয় চোখের সামনে।

এই কাহিনীর মধ্যে যখন শ্রমিকরমণী প্রবেশ করে তখন বেঁচে থাকার তাগিদেই তিনজনে যেভাবে শ্রম ভাগ করে নেয় তাতে মনেই হয় না আগন্তক যে নারী সে বিষয়ে পুরুষ দু’জন সচেতন। এটাই ঘটেছিল ইতিহাসে।তাই দেখি তিনজন শ্রমজীবী নারীপুরুষ বিভেদ ভুলে খাটছে এবং বাঁচছে,…এভাবে তিনজন ক্ষুধার্ত মানুষেল মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করতে করতে মৃণাল সেন অতি সুক্ষ্মভাবে গিয়ে পৌঁছান সারা পৃথিবীর সব সমাজের আদি কথায়। সত্যি সব সমাজই এক সময়ে ছিল মাতৃতান্ত্রিক। (শ্রমিক নারী অন্তঃসত্ত্বা হলেপিতা কেসে প্রশ্ন ওঠে) সন্তানের পিতাকে কারো জানার দরকার হত না। লোকে জিজ্ঞাসা করতো মাতা কে?…

জেনেসিস’ ছবির গোড়ায় যে দুই পুরুষকে আমরা দেখেছিলাম যৌথ শ্রমে ঐক্যবদ্ধ, ছবির শেষে দেখি তারা যুক্তিহীন ঘৃণায় পরস্পরকে আঘাত করছে। আর সেই সুযোগে ঢুকে আসে কোম্পানির বাহিনী। শ্রমিক শ্রেণির অনৈক্যের সুযোগ ব্যতীত কবে কোথায় আক্রমণ চালাতে পেরেছে শোষক? মেশিনের তান্ডবে ছবি শেষ হয়।’ (প্রসঙ্গে মৃণাল সেন: চলচ্চিত্র সমালোচনা, সম্পাদনা বিভাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠাক্রম ৩৩৬,৩৩৭)

তিনজন মানুষ একসঙ্গে বসবাস করেও পিতৃত্বের অহংকারী দাবিতে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে ঘৃণায় আর প্রতিহিংসায়যা ‘হকদারি’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। তাই সর্বহারা নারী যখন দুই পুরুষের দাবিকে উপেক্ষা করে বলে ওঠে, ‘সন্তান তোমাদের মধ্যে কার বলতে পারবো না, তবে এটা জানি সে আমার’, তখন কেবল মাতৃতন্ত্রের নয়জয়ধ্বনিত হয় জীবনেরমানবতার। আর শ্রম অনৈক্য পুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর দিকটিতে তুলে ধরে।

অসাধারণ চিত্রনাট্যের খাঁজে খাঁজে প্রচুর মন্তাজসিম্বলডিটেলসের অনবদ্য প্রয়োগ ঘটিয়েছেন মৃণাল, যা ছবিটিকে উচ্চমানে পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে। যেমন দোলনার অনুষঙ্গটি চমৎকার একটি সিম্বল, যা তিনজনের প্রণয় সুখ ও স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক। যখন তিনজনের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয় তখন দোলনাটি যেন চরিত্রে রূপ নেয় এবং যখন সেটি ভেঙে ফেলা হয় এক অসামান্য দ্যোতনার সৃষ্টি করে। তেমনই মেলা থেকে ফেরার সময় যখন চাষি ও তাঁতি পথ হারিয়ে ফেলে নারীটির কণ্ঠসংকেত ও লুণ্ঠন হাতে তাদের আলো দেখানোর দৃশ্যটি চমৎকার কিছু মন্তাজ তৈরি করে।

কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত সুষম একটি চলচ্চিত্র। ভারত, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের যৌথ প্রযোজনা এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নীতিশ রায়ের বাস্তবানুগ শিল্প নির্দেশনা ভগ্নস্তুপের বাস্তবতাকে রীতিমত কাব্যময়তা এনে দিয়েছে। তেমনই অনন্য কার্লে ভারিনির পরিশ্রমী চিত্রগ্রহণ। এলিজাবেথ ওয়েলেসলির দ্যুতিময় ও ছান্দিক সম্পাদনা অতুলনীয়। প্রতিটি দৃশ্য ও দৃশ্যাংশের সংযুক্তি এতটাই সুসংহত যে সম্পূর্ণ ছবিটাকে একটা বিরতিহীন দৃশ্য বলে মনে হয়। আর রবিশঙ্করের সঙ্গীত বরাবরের মতোই ধ্রুপদী আঙ্গিকের। সরু অঞ্চলের লোকসংগীতের প্রয়োগ তিনি ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সুচারু ও পরিমিতভাবে। অভিনয়াংশ নিয়ে বললে বলতে হয় নাসিরুদ্দিন শাহ্‌, ওম পুরী ও শাবানা আজমী ছাড়া এ ছবি নির্মাণ করা সম্ভব হতো না। এই ত্রয়ীর দুর্দান্ত অভিনয়ের পাশে এম.কে. রায়না অনেকটাই নিষ্প্রভ। হয়তো বা অমরীশ পুরীই যুৎসই ছিলেন এই চরিত্রে।

প্রলয় শূর ‘জেনেসিস’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মৃণাল সেন মনে করিয়ে দিলেন, ছবিতে আমরা ‘যেটুকু দেখি, তারচেয়ে অনেক বেশি আমাদের দেখার আছে।’ ‘প্রসঙ্গ মৃণাল সেন: চলচ্চিত্র সমালোচনা, সম্পাদনা বিভাস মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠাক্রম ৩৩৪) আসলেই তাই চৈনিক সে প্রবাদ ‘লাইনস বিটুইন টু লাইনস’এর অনুকরণে ‘জেনেসিস’ প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘সিনস বিটুইন টু সিনস’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় মানুষটি প্রিয়তর হোক
পরবর্তী নিবন্ধপশ্চিম বাকলিয়া চিটাগং ইডেন ক্লাবের সভা