জু’ম আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে আউলিয়ায়ে কেরামের মর্যাদা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন আউলিয়া কেরাম আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা। সুদুর অতীত থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামের মর্মবানী ও আদর্শের প্রচার প্রসার ঘটেছে অলি আউলিয়া সুফি সাধক ও গাউস কুতুবদের মাধ্যমে। আল্লাহর অলীদের অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ সহজ সরল পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন এতদঞ্চলের জন সাধারণকে ইসলামের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছে। তাঁদের প্রচারিত তরিকার নীতি পদ্ধতির অনুসরণে সত্যান্বেষী মানুষেরা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ লাভ করেছে। তাদের তাকওয়া ভিত্তিক জীবনাদর্শের অনুসরণে এদেশে ইসলামের ভিত সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়েছে।

অলী শব্দের অর্থ: অলী শব্দ আরবি “ওলায়ুন” থেকে নির্গত, এর অর্থ সাহায্য করা, তত্বাবধান করা, ভালবাসা আনুগত্য করা ইত্যাদি। “মাওলা” শব্দও ওলায়ুন শব্দ থেকে নির্গত। যিনি প্রকৃত অলী তিনি আল্লাহর আনুগত্যকারী হবেন এবং বান্দার সাহায্যকারী হয়ে থাকেন। অলীর সংজ্ঞা বর্ণনায় আল্লামা সাদ উদ্দিন মাসউদ বিন ওমর তাফতাযানী (.) (ওফাত: ৭৯৩ হি.) বলেন, অলী ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়। যিনি মহান আল্লাহর সত্তা ও এবং তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত। যিনি সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকেন। সকল প্রকার গুনাহ থেকে নিজেকে হিফাজত করেন এবং কুপ্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত থাকেন। (শরহুল আকাঈদ, পৃ: ১৪৪)

কুরআনের আলোকে অলীদের মর্র্যাদা: অলি আউলিয়া শব্দটি কুরআনের পরিভাষা। এটি মানবরচিত গ্রন্থের পরিভাষা নয়। আরবি বর্ণমালার তিন অক্ষরের “অলী” শব্দটি প্রতি অক্ষরে দশটি নেকী হিসেবে তিন অক্ষরে ত্রিশটি নেকী, আমল নামায় অর্জিত হয়। অলীদের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, নিশ্চিত জেনে রাখ, যারা আল্লাহর অলি বা বন্ধু তাঁদের কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবেনা, সেই অলিগণ তারাই যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে। (আল কুরআন,সুরা ইউনুস, আয়াত: ৬২৬৩)

বর্ণিত আয়াতের প্রতি গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে প্রতীয়মান হয় যে, পরকালে ভয়হীন ও চিন্তামুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় ঈমান ও তাকওয়া অর্জন। অন্য আয়াতে পরকালে অভয় ও চিন্তামুক্ত থাকার জন্য সুদৃঢ় ঈমান ও সৎকর্ম সমূহ পালন করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় যাঁরা ঈমান আনয়ন করেছে, সৎকর্ম করেছে, নামায কায়েম করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে তাঁদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট (এসবের) প্রতিদান রয়েছে, আর তাদের কোন ভয় নেই তারা চিন্তিতও হবেনা। (সূরা: আল বাকারা, ২৭৭)

এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যিনি অলি তিনি মু’মিন ও মুত্তাকী হবেন। প্রকৃত অর্থে যারা মু’মিন ও মুত্তাকী তাঁরাই আল্লাহর অলি। যারা এর ব্যাতিক্রম তারা আল্লাহর অলি নয়। তাদের জন্য পরকালে ভয়হীন ও চিন্তামুক্ত থাকারও কোন আশ্বাস নেই। অলিগন বহুবিধগুণে গুণান্বিত, যিনি মু’মিন তিনি মুত্তাকী তিনি অলিও বটে। আবার যিনি অলি তিনি মু’মিন ও মুত্তাকীও বটে। এ তিনটি একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন গুণবাচক নাম।

আল্লাহর অলির সঠিক পরিচয়: আমরা যদি সূরা ইউনুসের বর্ণিত আয়াতের দিকে লক্ষ্যকরি, একজন আল্লাহর অলির সঠিক পরিচয় জানতে পারি। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নিজেই অলির সংজ্ঞা দিয়েছেন “অলি তাঁরাই যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে” তাকওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে সাহাবী হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.) হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন, আপনি কি কখনো কাটাপূর্ণ রাস্তায় পথ চলেছেন? হযরত ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ চলেছি, হযরত উবাই (রা.) বললেন, তখন কিভাবে পথ চললেন? তিনি বললেন, নিজেকে খুব সামলিয়ে সতর্ক হয়ে চলেছি, হযরত উবাই (রা.) বললেন, এটাই তাকওয়া। তাফসীরে “রহুল মাআনী” এর বর্ণনামতে আল্লামা আলুসী (.) তাকওয়া প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, তাকওয়া হচ্ছে যে কাজ থেকে আল্লাহ তোমাকে বারণ করেছেন, সেখানে যেন তিনি তোমাকে না দেখেন, আর যা করতে তিনি আদেশ করেছেন সেখানে যেন তোমাকে অনুপস্থিত না দেখেন। (তাফসীর রুহুল মা’আনী ১ম খন্ড, পৃ: ১০৮)

অলী হওয়ার জন্য অলৌকিক কর্ম প্রদর্শিত হওয়া শর্ত নয়। যারা কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক শরীয়তের আদেশ ও নিষেধ পূর্ণভাবে মেনে চলবেন তারা একেকজন আল্লাহর অলিতে পরিণত হবেন। সমাজে মানুষের কাছে তাঁদের অীল হিসেবে পরিচিতি না থাকলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা অলি হিসেবে পরিগণিত। শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে কোন প্রকার অলৌকিক কর্মকান্ড প্রদর্শিত হতে দেখলেও তাকে অলি মনে করার কোনো কারণ নেই, তাকে অলি হিসেবে মন্তব্য করার পূর্বে সে ব্যক্তির তাকওয়া ও ধর্মীয় অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা বাঞ্চনীয়। এ বিষয়ে হযরত ইমাম শাফিঈ (রা.)’র একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, কাউকে পানিতে চলতে বা বাতাসে উড়তে দেখলে কুরআন ও হাদীসের সাথে তার অবস্থা মিলিয়ে না দেখা পর্যন্ত প্রতারিত হয়োনা। (শরহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ, পৃ: ৫৭৩)

অলির জন্য শরয়ী জ্ঞান থাকা শর্ত: ঈমান আক্বিদা ও আমলের হিফাজতের জন্য শরয়ী জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কোন মূর্খ ব্যক্তি অলি হতে পারেনা। আ’লা হযরত ঈমাম আহমদ রেযা খান (রহ.) (ওফাত ১৩৪০) এরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা কোন জাহেল বা মুর্খকে অলি করেননি। তিনি কাউকে বেলায়তের নিয়ামত দ্বারা যদি ধন্য করতে চান প্রথমে তাঁকে শরয়ী জ্ঞান দান করেন। এরপর বেলায়তের মর্যাদা দানে ধন্য করেন। যে ব্যক্তি ইলম জাহিরের অধিকারী হননি সে ইলমে বাতিনের ফলাফল কীভাবে অর্জন করতে পারে? (ফাতওয়াই রযভীয়া ২১/৫৩০)

কোন পাপিষ্ট ও ফাসিক অলি হতে পারেনা। তাকওয়া হচ্ছে মু’মিনের নিয়ামক শক্তি, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তাকওয়া সম্পন্ন লোকেরাই হচ্ছে অলি”। (সূরা: আনফাল, আয়াত: ২৩)

প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) আয়াতের তাফসীরে বলেন, কোন পাপিষ্ট ও ফাসিক অলি হতে পারেনা। অলীগণ আল্লাহর প্রিয় ভাজন বন্ধু। আল্লাহর পথে বান্দার নৈকট্য ও বন্ধুত্ব ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে, সদরুল আফাযিল হাকিম মুফতি নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (.)। সূরা: ইউনুস’র ৬২৬৩ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন। অলি হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ আক্বিদা সম্পন্ন হওয়া শর্ত। তিনি কুরআন সুন্নাহর আলোকে শরীয়ত সম্মত ভালকর্ম গুলো সম্পন্ন করেন। অলি কখনও শরীয়তের বিপরীত অবস্থান নেন না। (খাযাঈনুল ইরফান, সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৬২)

বেলায়ত আল্লাহর এক বিশেষ নৈকট্য: মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়ভাজন বান্দাদেরকে অফুরন্ত দয়া অনুগ্রহ ও বিশেষ করুণা দ্বারা নৈকট্য দান করেন। মুফতি আমজাদ আলী আযমী (রা.)’র বর্ণনামতে বেলায়ত আল্লাহর প্রদত্ত দান।

বেলায়তের প্রকারভেদ: কতেক অলি জন্মগতভাবে অলি হয়ে থাকেন, এ প্রকারকে “বেলায়তে আতায়ী” বলা হয়। যেমন হযরত বিবি মরিয়ম (.) জন্মগত ভাবে ওয়ালিয়া ছিলেন।

বেলায়তে তাশরিঈ: প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকী সৎকর্ম পরায়ন, আল্লাহর নৈকট্য লাভে যিনি ধন্য হয়েছেন, তাকে অলিয়ে তাশরিঈ বলা হয়। প্রত্যেক চল্লিশ জন মু’মিন মুত্তাকী মুসলমানদের মধ্যে একজন অলিয়ে তাশরিঈ হয়ে থাকেন।

অলিয়ে তাকভিনী: যাকে আল্লাহর রাজত্বে ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এস্তরের বেলায়তকে বেলায়তে তাকভিনী বলা হয়। গাউস কুতুব আবদালগণ এ বিশেষ শ্রেণিভূক্ত। কিয়ামতের কঠিন ক্রান্তিকালে এরা সকল প্রকার ভয়ভীতি, দু:খ কষ্টের যন্ত্রণা থেকে নিরাপদ ও আশংকামুক্ত।

অলীদের সম্পর্কে ইসলামী আক্বিদা: শরীয়ত ও তরীক্বত একটি অপরটির পরিপূরক। তরীকত শরীয়তের বিপরীত নয়। বর্তমান সমাজে এক শ্রেণির নামধারী তরিকত পন্থি যারা ধারনা করে শরীয়ত এক জিনিষ, তরীকত এক জিনিষ। এ ধরনের ধারণা গোমরাহীর নামান্তর। নিজকে তরীকতপন্থি দাবীকরে শরীয়তের গন্ডি থেকে নিজকে মুক্ত মনে করা সুস্পষ্ট কুফরীও ধর্মদ্রোহীতা। (বাহারে শরীয়ত ১ম খন্ড, পৃ: ৮৯)

অলীদের কারামত সত্য: আল্লামা ইবনু হাজর মক্কী (.) বলেন, অলীদের কারামত সত্য। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা। এর বিরোধীগণ বাতিল, তথা মুতাযিলা ফিরকার অন্তর্ভূক্ত। (ফতোয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ, /৭৮)

আল্লাহ তা’আলা কখনো তাঁর বান্দার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কখনো তাঁদের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অলৌকিক ঘটনা ও বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ করে থাকেন। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে কারামাত বলা হয়। যেমন হযরত মরিয়ম (.) মৌসুম বিহীন অদৃশ্য জগতের ফললাভ করা। হযরত মরিয়ম (.)’র জন্য জান্নাত থেকে ফল ফলাদি আসতো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “যখন যাকারিয়া তাঁর নিকট তাঁর নামায পড়ার স্থলে যেতেন তখন তাঁর পাশে খাদ্য সামগ্রী দেখতে পেতেন, তিনি বলল হে মরিয়ম! ইহা তোমার কাছে কার পক্ষ থেকে এসেছে? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে, নিশ্চয় আল্লাহ যাকে চান সীমাহীন রিযক দান করেন। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩৭)

হাদীস শরীফের আলোকে অলীদের মর্যাদা:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন আল্লাহ তা’আলা বলেন, যে আমার অলির সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৫০২)

অলিদের প্রতি বিদ্বেষ নয়, তাদের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করুন। ইসলাম প্রচারে তাঁদের ত্যাগ ও অবদান স্বীকার করুন। তাঁদের বিরোধীতা নয় তাদের ফয়েজ ও বরকত অর্জন করে নিজকে ধন্য করুন। তাদের মাযার যিয়ারত করা মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর ও বরকতময়। তাদের জন্য ঈসালে সওয়াব করা, শরীয়ত সম্মত পন্থায় ওরছ উদযাপন করা বরকতময় ও মুস্তাহাব। মাযার ও ওরছ কেন্দ্রিক শরীয়ত পরিপন্থি কার্যক্রম করা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য ও নিন্দনীয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে অনুধাবন করা ও তাঁদের ফয়েজ বরকত অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিরে দেখা : দৈনিক আজাদী, আগামীদের আসর ও আত্মবিশ্বাসের জায়গা
পরবর্তী নিবন্ধবাকলিয়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন