আল কুরআনের আলোকে নবীজির মর্যাদা: নূরনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের উপর অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব আলকুরআন বিশ্ব মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ও মুক্তির সনদ। মহান আল্লাহকে প্রাপ্তির পূর্বশর্ত তাঁর মহান রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা স্থাপন করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসাকে আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের জন্য আবশ্যক করে দিয়েছেন। তাঁকে জানতে হলে পবিত্র কুরআনের আলোকে তাঁর নিখুঁত আদর্শ ও মর্যাদার কথা জানতে হবে। তাঁর পরিচয় হলো তিনি আল্লাহর রাসূল ও সর্ব শেষ নবী। নবীজিকে মহান রাসূল হিসেবে তাঁর রিসালাতের মর্যাদাকে অনুধাবন করাই তাঁর মূল পরিচয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের পূরুষদের কারো পিতা নয় তবে তিনি আল্লাহর রাসূল ও নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। (সূরা: আহযাব, আয়াত: –৪০)
তাঁর নবুওয়ত ও রিসালাত বিশ্বজনীন: তিনি নির্দিষ্ট কোনো জাতির জন্য নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন এলাকার জন্য আগমন করেননি। তাঁর রিসালাত ও রহমত ভৌগলিক কোনো সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর রিসালাত বিশ্বজনীন, সার্বজনীন তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণের মূর্ত প্রতীক। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর নিশ্চয় আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।” (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “হে নবী! আপনি বলুন, হে মানব মন্ডলী, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর রাসূল।” (সূরা: আ’রাফ, আয়াত: ১৫৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি তাজিম ও আদব রক্ষা করা ফরজ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি তাজিম ও আদব রক্ষার নাম ঈমান। তাঁর প্রতি বেয়াদবী কটুক্তি অশালীন শব্দ চয়ন, ধৃষ্ঠতা প্রদর্শন, অসম্মান ও অবমাননা করা নিঃসন্দেহে কুফরী। সাধারণত একে অন্যকে যে ভাবে ডাকাডাকি করে সে পদ্ধতিতে নবীজিকে ডাকা আহবান করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। বরঞ্চ তাঁকে ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ইয়া শাফিয়াল মুযনিবীন ইত্যাদি উপাধি সম্বলিত সম্মান সূচক শব্দ দ্বারা আহ্বান করো। (শানে হাবীবুর রহমান, হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী, র.)
নবীজির প্রতি অসম্মান করলে আমল বরবাদ হয়ে যাবে: নবীজির প্রতি আদব রক্ষা সকল ইবাদতের মূল। নূর নবীজির প্রতি সামান্যতম অশ্রদ্ধা, অবমাননা বেয়াদবী জীবনের সব আমল নিমিষে নিষ্ফল হয়ে যাবে। সারাজীবনের নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, জনসেবা সমাজসেবা, ধর্ম কর্ম, সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে বিনষ্ট হয়ে যাবে যদি না নবীজির প্রতি যথার্থ সম্মান ও আদব রক্ষা হয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগন! তোমরা নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু করোনা। নবীজির কণ্ঠ স্বরের উপর এবং তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বলোনা যেভাবে পরস্পর একে অপরের সামনে চিৎকার করো যেন তোমাদের আমলসমূহ নিস্ফল না হয়ে যায়, আর তোমাদের খবর থাকবেনা। (সূরা: হুযরাত, আয়াত: ২)
নবীকে ভালোবাসালে আল্লাহ বান্দাকে ভালোবাসবেন: নবীজিকে ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। নবীজির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা কুরআনের মগজ ঈমানের প্রাণ, ধর্মের প্রাণ, মু’মিনের অন্তরে নবী প্রেম ‘ঈমানের অমূল্য সম্পদ। নবীর প্রতি শত্রুতা বিদ্বেষ পোষণ করা নবীজির আদর্শের বিরোধীতা করা কুফরীর নামান্তর। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মাহবুব আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো তবে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৬৩১)
সাহাবায়ে কেরাম নবীজিকে নিজেদের পিতা মাতা, সন্তান–সন্ততি, আত্মীয় স্বজন, নিজ সম্পদ জীবনের সব কিছুর চাইতে অধিক ভালবাসতেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ আমি তার নিকট তার পিতা মাতা তার সন্তানাদি ও সকলের চেয়ে প্রিয় পাত্র না হই। (ইমাম নাসাঈ, সুনান, হাদীস: ৫০২৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার দাবী হলো নবীজি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা এনেছেন তা গ্রহণ করা, যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা।
নবীজির শানে মানহানিকর শব্দ ব্যবহর করা হারাম: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে শব্দ চয়ন ও ব্যবহারে আদব রক্ষা করা ও সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। যে শব্দের দুটি অর্থ আছে একটি ভাল অন্যটি মন্দ। এমন শব্দও রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শানে ব্যবহার করা নিষেধ। যদিও মানহানি করার উদ্দেশ্যে না থাকে। এতে নবী বিদ্বেষীরা শব্দের খারাপ অর্থটি গ্রহণ করে যাতে বেয়াদবি করার সুযোগ না পায়। যেমন আরবি শব্দ (রা‘ইনা)’র এক অর্থ আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি প্রদান করুন। যে অর্থটি উদ্দেশ্য করে সাহাবায়ে কেরাম নবীজির শানে শব্দটি ব্যবহার করতেন, নবীজির খিদমতে আরয করতেন “রা–ইনা ইয়া রাসূলাল্লাহ” অর্থ্যৎ ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি দিন। একই শব্দটি ইহুদীদের ভাষায় রাখাল অর্থে ব্যবহার হতো। এ সুযোগে ইয়াহুদীরা অসৎ উদ্দেশ্যে কুমতলবে বেয়াদবী ও ধৃষ্ঠতার নিয়তে নবীজির মানহানি করার উদ্দ্যেশে ইয়াহুদীরা যখন নবীজির সুমহান শানে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে শব্দটি বলা শুরু করলো, তখন আল্লাহ তা’আলা নবীজির সুমহান মার্যাদা সুরক্ষায় নবীজির শানে (রা‘ইনা) শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আয়াতে করীমা নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! “রা‘ইনা” বলোনা এবং এভাবে আরয করো হুযুর আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি রাখুন এবং প্রথম থেকেই মনোযোগ সহকারে শুনো। আর কাফিরদের জন্য বেদনাদায়ক শাস্তি অবধারিত। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ১০৪)
মক্কা বিজয়ের দিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের ক্ষমা করেন নি: মক্কা বিজয়ের দিন রাহমাতুল্লীল আলামীন নূরনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে ক্ষমা করলেও তাঁর প্রতি চরম অবমাননাকারীদের ক্ষমা করেননি। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত সাদ–রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা ব্যতীত সকল মানুষকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। নবীজি এরশাদ করেন, তাদেরকে তোমরা হত্যা কর যদিও তারা কা’বার গিলাফের নিচে থাকে। ঐ সব কমবখত পুরুষ হল ইকরামা বিন আবি জেহল, আবদুল্লাহ ইবন খাত্তাল মুকিস ইবন সুবাবা, আবদুল্লাহ ইবন সাদ ইবন আবি সারাহ। (আবু দাউদ, হাদীস: ২৬৮৩)
হাদীস বিশারদদের অভিমত: নবীজির মর্যাদার অবমাননা করা, মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করা, নবীজিকে গালমন্দ করা, নিঃসন্দেহে কুফরি। এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগন, তাফসীরকার ও হাদীস বিশারদগন, ঐক্যমত পোষন করেছেন, প্রখ্যাত হাদীস বেত্তা হযরত মুহাম্মদ ইবন সাহনুন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সকল উলামা এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেন যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দকারী তাঁর শান মান ক্ষুন্নকারী কাফির। তার জন্য আল্লাহর শাস্তির ধমক রয়েছে, তার বিষয়ে শরয়ী সিদ্ধান্ত হলো এটা হত্যাযোগ্য অপরাধ। যে ব্যক্তি তার কুফরি ও শাস্তির বিষয়ে সন্দিহান হবে সেও কাফির। (ইমাম কাযী আয়ায আশ–শিফা, পৃ: ৪০৫)
ফতোওয়ায়ে “শামী”তে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেরিত নবীদের থেকে কোন নবীকে গালমন্দ করল তার তাওবা কবুল হবেনা এবং যে ব্যক্তি তার কুফরি হওয়া ও শাস্তির যোগ্য হওয়াকে সন্দেহ করল সেও কুফরি করল। (দুরুল মোখতার)
ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) বলেন, যে কোন মুসলিম ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মন্দ বলে কিংবা মিথ্যাবাদী বলে কিংবা নবীজির দোষচর্চা করে অথবা অসম্মানসূচক কথা বলে নিশ্চয়ই সে কুফরি করল এবং তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। (কিতাবুল খিরাজ)
হাদীস শরীফের আলোকে নবীজির অনন্য মর্যাদা: নবীজি অনন্য অসাধারণ অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী পবিত্র সত্বা। মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র সত্বায় পূর্ণমাত্রায় সকল গুণাবলীর সমাহার ঘটিয়েছেন, হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সত্বার পরিচয় প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি সকল নবীদের সরদার, এতে কোন অহংকার নেই, আমি সর্ব শেষ নবী, এতে কোন অহংকার নেই, আমি সর্বপ্রথম সুপরিশকারী যার সুপারিশ গৃহীত হবে এতে কোন অহংকার নেই। (সুনানু দারেমী, হাদীস: ৫০)
হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উম্মত হিসেবে কবুল করুন। আমাদের ক্ষমা করুন। তাঁর সুমহান মর্যাদা বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব,
কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।











