অযুর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ:
আরবি তিনটি বর্ণ এর সমষ্টি অযু, ওয়াও বর্ণে পেশ যোগে “উযু” অর্থ হলো পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা। ওয়াও বর্ণে যবর হলে যে পানি দ্বারা অযু করা হয় তাকে “অযু” বলা হয়। ওয়াও বর্ণে যের হলে “বেযু” যে পাত্র পানি রেখে অযু করা হয় তাকে বেযু বলা হয়। (সুবুলুস সালাম ১ম খন্ড, পৃ: ৩৯)
পারিভাষিক অর্থ:
পবিত্র পানি দ্বারা মুখমন্ডল, হাত ও পা ধৌত করা এবং মাথা মাসেহ করাকে শরীয়তে অযু বলা হয়। (ফিকহ’র কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)
পবিত্র কুরআনের আলোকে অযুর গুরুত্ব:
অযুর অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমানিত, অযু নামাাযের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগন তোমরা যখন নামাযের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও দু’ হাত কনুইসহ ধৌত করবে, তোমাদের মাথা মুছেহ করবে তার পর দু’পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত করবে। (সূরা: মায়েদাহ, ৫:৬)
অযুর ফরজ চারটি:
১. মুখ মন্ডল ধৌত করা, ২. দু’ হাতের কনুইসহ ধৌত করা, ৩. মাথা মুছেহ করা, ৪. দু’পায়ের টাখনুসহ ধৌত করা। কোন অঙ্গ ধৌত করার অর্থ হলো অঙ্গের প্রত্যেক অংশে যেন পানি প্রবাহিত হয়। কপালের শুরু থেকে মুখমন্ডল ধৌত করা অর্থাৎ প্রস্থে চিবুক পর্যন্ত এক কান হতে দ্বিতীয় কান পর্যন্ত মুখমন্ডলের অন্তর্ভূক্ত। এ সীমানার মধ্যে চামড়ার প্রত্যেক অংশে পানি প্রবাহিত করা ফরজ।
মাসআলা: দু’ হাত ধৌত করার ক্ষেত্রে যদি কনুই থেকে নখ পর্যন্ত কোন স্থান বিন্দুমাত্র ধৌত থেকে বাদ পড়ে অযু হবে না। (বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড, পৃ: ২২)
হাতের আঙ্গুলের আটটি ফাঁক আঙ্গুলের পাশ্বে নখের ভেতরে যে খালি জায়গা আছে এবং হাতের কজ্বির প্রত্যেক লোম গোড়া থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সবস্থানে পানি গড়িয়ে যাওয়া জরুরী। কারো পাঁচটির স্থলে ছয়টি আঙ্গুল থাকলে সবগুলো ধৌত করা ফরজ।
মাসআলা: মাথার এক চতুর্থাংশ মাসেহ করা ফরজ। কোন অঙ্গ মাসেহ করার পর হাতে যে আদ্রতা বাকী থাকে তা অন্য অঙ্গ মাসেহ করার জন্য যথেষ্ট হবে না।
মাসআলা: পাগড়ী, টুপি, চাদর, ওড়নার উপর মাসেহ যথেষ্ট নহে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড ১ম, পৃ: ২৩)
মাসআলা: উভয় পায়ের টাখনুসহ একবার ধৌত করা ফরজ।
মাসআলা: যদি অযু না থাকে তখন নামায, সিজদায়ে তিলাওয়াত, জানাযার নামায ও কুরআন মজীদ স্পর্শ করার জন্য অযু করা ফরজ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ১ম, পৃ: ৩১)
হাদীস শরীফের আলোকে অযুর গুরুত্ব: অযু করলে গুণাহসমূহ ঝরে যায়। মানুষ প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যা, দিবা রাত্রি ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কতো রকমের গুনাহ করে তার হিসেবে নেই। করুণাময় দয়াবান আল্লাহ বান্দার গুণাহ ক্ষমা করার জন্য অনেকগুলো বরকতময় আমল দিয়েছেন তন্মধ্যে অযু এমন একটি আমল যা উত্তমরূপে সম্পাদন করলে বান্দার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে অসংখ্য গুনাহ ঝরে যায়। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) আবদুল্লাহ সুনাবিহী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অযু করে তখন তার গুণাহসমূহ মুখ ও নাক দিয়ে বের হয়ে যায় যখন সে তার মুখমন্ডল ধৌত করে তখন তার গুণাহসমূহ মুখমন্ডল থেকে বের হয়ে যায়। এমনকি তার দু’চোখের ভ্রুর নিম্নাংশ থেকেও গুনাহ বেরয়িে যায়। যখন সে তার উভয় হাত ধৌত করে তখন তার উভয় হাত থেকে গুনাহ বের হয়ে যায়। এর পর যখন সে তার মাথা মাসেহ করে তখন তার মাথা হতে গুনাহ সমূহ ঝরে যায়। এমনকি তার কর্ণদ্বয় থেকেও গুনাহ সমূহ ঝরে যায়, যখন সে তার উভয় পা ধৌত করে তখন তার উভয় পা থেকে গুনাহসমূহ ঝরে যায়, এমনকি দু’পায়ের নখের নিম্নভাগ থেকে গুনাহ ঝরে যায়। এরপর তার সালাত আদায় করা এবং মসজিদের দিকে আসার সাওয়াব অতিরিক্ত। (ইবনে মাযাহ, হাদীস :২৮২)
মু’মিনগণ অযুর প্রতি যত্নবান থাকে: অযু তথা পবিত্র অবস্থায় থাকা মু’মিনের অন্যতম বৈশিষ্ট। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত সওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, যদিও তা তোমরা আয়ত্তে রাখতে পারবেনা আর তোমরা জেনে রেখো! তোমাদের আমল সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম আমল হলো সালাত। আর মু’মিন ব্যাতীত অন্য কেউ অযুর প্রতি যত্নবান হয় না। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২৭৭)
অযুর সুন্নাত: হানাফী মাযহাবের ফিকহর কিতাব সমূহের বর্ণনা মতে অযুর সুন্নাত চৌদ্দটি। ১. নিয়্যাত করা। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ পালনের নিয়্যতে অযু করাটা জরুরী। আ’লা হযরত (র.)’র বর্ণনামতে অযুর মধ্যে নিয়্যত না করার অভ্যস্ত ব্যক্তি গুনাহগার হবে। (ফতোয়ায়ে রযবীয়া, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৬১৬)
২. বিসমিল্লাহ ওয়ালহামদুলিল্লাহ পড়া, ৩. উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা, ৪. মিসওয়াক করা, মিসওয়াক না থাকলে আঙ্গুল দ্বারা হলেও মিসওয়াক করা সুন্নাত। (নূরুল ঈযাহ, অযুর অনুচ্ছেদ, পৃ: ২৬) ৫. তিনবার কুলি করা, ৬ রোযাদার না হলে গড় গড়া করা, ৭. তিনবার নাকে পানি দেয়া, ৮. দাড়ির নীচ থেকে দাড়ি খিলাল করা, ৯ ও ১০. হাতের ও পায়ের আঙ্গুল সমূহ খিলাল করা, ১১. সম্পূর্ণ মাথা একবার মাসেহ করা, ১২. উভয় কান মাসেহ করা, ১৩. অযুর ফরজ গুলোতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ১৪. একটি অঙ্গ শুকানোর আগে অন্য অঙ্গ ধৌত করা। (বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড, পৃ: ২৯৪)
অযুতে পানি অপচয় করা নিষিদ্ধ: আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা অযথা ব্যয় করোনা নিশ্চয়ই অযথা ব্যয়কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। (সূরা: আনআম, আয়াত: ১৪১)
অযুতে পানির অপচয় নিষিদ্ধ হওয়াটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। নিষেধাজ্ঞার হুকুম মূলত: হারাম হওয়াকে বুঝায়। সুতরাং অযুতে পানির অপচয় করাও সম্পূর্ণরূপে হারাম। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়্যা, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা, ১ম খন্ড: পৃ: ৭৩১)
অপচয় করা শয়তানের কর্ম: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অযুতে প্রচুর পানি ব্যবহারে কোন কল্যাণ নেই তা শয়তানের কর্ম। (কানযুল উম্মাল, হাদীস: ২৬২৫৫)
অযু অবস্থায় মৃত্যু বরণকারী শহীদের মর্যাদা পাবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মালাকুল মউত যে বান্দার রুহ অযু অবস্থায় বের করেন তার জন্য শাহাদাতের মর্যাদা লিখে দেয়া হয়। (শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং: ২৭৮৩)
হাসির দ্বারা অযু ভঙ্গ হওয়ার বিধান: হাসি তিন প্রকার, ১. অট্টহাসি, ২. সাধারণ হাসি, ৩. মুচকি হাসি। যে হাসির শব্দ নিজেও শুনে পার্শ্ববর্তী লোকেরাও শুনতে পায় তাকে অট্টহাসি বলে, নামাযের মধ্যে অট্টহাসি দ্বারা অযু ও নামায উভয়টি ভঙ্গ হয়ে যায়। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
সাধারণ হাসিতেও নামায ভঙ্গ হয়ে যায় তবে অযুভঙ্গ হয় না। তাবাসসুম তথা মুছকি হাসি দ্বারা অযু ও নামায কোনটাই ভঙ্গ হয় না। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
ইসলামে অযুর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, পবিত্রতা ব্যাতীত নামায কবুল হয় না। হারাম মাল দ্বারা সাদকা কবুল হয় না। (মুসলিম ও তিরমিযী), ইসলাম পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পাদনে আল্লাহ ত’আলা পবিত্রতা অর্জন করাকে অপরিহার্য করেছেন। আল্লাহ তা’আলা অযুর গুরুত্ব, ফযীলত ও বরকত আমাদের নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রেজাউল করিম মামুন
খাগরিয়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: দাফনের পর কবরের উপর আযান দেওয়ার বিধান সম্পর্কে জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: পঞ্জেগানা নামায ও জুম’আর নামাযের জন্য আযান দেয়া সুন্নাত, মুজতাহিদ ফকীহগণের বর্ণনামতে কতিপয় স্থানে আযান দেয়া শরীয়ত সম্মত মুস্তাহাব ও পূন্যময় আমল। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুয়াজ্জিনের আওয়াজের শেষ পর্যন্ত যে কোন জ্বিন মানব বা অন্য কোন কিছু শুনতে পাবে কিয়ামত দিবসে প্রত্যেকে তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে (বুখারী শরীফ, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩, পৃ: ১৩৭)
নিম্ন বর্ণিত স্থানে আযান দেয়া মুস্তাহাব হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়। ১. নবজাত শিশুর কানে, ২. কোথাও আগুন লাগলে, ৩. যুদ্ধের সময়, ৪. চিন্তাগ্রস্ত ক্রোধান্বিত ও দু:খিত লোকের কানে, ৫. মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশ্বে, ৬. মৃত ব্যাক্তি দাফনের পর কবরের পাশে, ৭. মুসাফির রাস্তা ভুলে গেলে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড: ১, পৃ: ২০৮, “মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ”, ১ম খন্ড, আযান অধ্যায়, পৃ: ৪৫৫)
দাফনের পর কবরের পাশে আযান দেয়া জায়েজ ও উত্তম। (আনোয়ারুল হাদীস পৃ: ২৩৮ কৃত: মুফতি জালাল উদ্দিন আহমদ আমজাদী), দাফনের পর কবরে আযান দেয়ার বৈধতা ও উত্তম হওয়া প্রমানে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) লিখিত স্বতন্ত্র প্রামান্য কিতাব “ইযানুল আযর ফী আযানিল কবর” (ফতোওয়ায়ে ফয়জুর রসূল, খন্ড:১ম, পৃ: ২২৬)