জুম্‌’আর খুতবা

বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৯ জুন, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! আল্লাহর কুরআন ও নবীজির সুন্নাহকে অনুসরণ করুন। রাসূলুল্লাহর পবিত্র আদর্শ জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় অমূল্য ভাষণ ও বাণীগুলো বিশ্ব মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করুন। ১০ম হিজরির ৯ জিলহজ্ব রোজ শুক্রবার নবীজির পদধূলিতে ধন্য আরাফাতের বিশাল ময়দানে একলক্ষ চব্বিশ হাজারের অধিক সাহাবায়ে কেরাম ও মুসলিম উম্মাহর উদ্দ্যেশে নবীজির প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ যা তাফসীর হাদীস ও ইতিহাসের পরিভাষায় বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে প্রসিদ্ধ। বিশ্ব মানবতার সামগ্রিক মুক্তি ও শান্তি স্থাপনে উপরন্তু নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ অভ্রান্ত যুগান্তকারী ভাষণকে মুক্তির মাইলফলক ও আলোক বর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করুন।

বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনবদ্য দলিল: ইসলামই একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন বিধান ও আল্লাহর মনোনীত ধর্ম হিসেবে আরাফার ময়দানে বিঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা: আল মায়িদা)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)

ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যেখানে নারী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সুরক্ষায় রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ইসলাম পূর্ব যুগে সমাজে নারী জাতি ছিল সর্বত্র বঞ্চিত, অবহেলিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত ও উপেক্ষিত। কোন পরিবারে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হওয়াকে কুলক্ষণের কারণ ও অসম্মান অপমানবোধ করতো, জন্মদাতা পিতা নিজ কন্যার প্রতি বর্বরতা ও নিষ্ঠরতার এক জগন্য অমানবিক আচরণ প্রদর্শন করতো নবজাত শিশু কন্যাকে জীবন্ত মাটিতে পুতে ফেলা হতো। ইসলাম এ নিকৃষ্টতম ঘৃণ্য প্রথাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যখন জীবন্ত সমাধিস্ত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো? (সূরা: তাকভীর, আয়াত: )

ইসলামে পুরুষের পাশাপাশি নারী জাতির কর্মকে যথার্থরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে তাকে কখনো মা হিসেবে কখনো স্ত্রী হিসেবে কখনো কন্যা হিসেবে সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারী জাতির সৃষ্টিকে মহান আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সহধর্মিনী সৃষ্টি করেছেন, যেন তাদের কাছে তোমরা বসবাস করতে পারো এবং তোমাদের মধ্যে পরস্পর ভালোবাসা দয়া সৃষ্টি করেছেন। (সূরা: রুম, আয়াত: ২১)

ইসলামে নারী জাতির গুণাবলীর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে: নারীর সৎ কর্মকে কোন ভাবেই অবহেলা অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নারীর উত্তম আমল ও সৎ কর্মের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে পবিত্র ইসলামে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ দানশীল নারী, যৌনাঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ যৌনাঙ্গ হিফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও যিকিরকারী নারী, তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৩৫)

নারীদের অধিকার সুরক্ষায় বিশেষ নির্দেশনা: বিদায় হজ্বের ভাষনে নারীদের বিষয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে, নারী জাতির অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত ভাষণের অংশ বিশেষ নিম্নরূপ: হযরত আমর ইবনুল আহওয়াস আল জুশামী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর প্রশংসা ও গুনগান বর্ণনার পর উপদেশ বানী এরশাদ করলেন, শুনো! আমি নারীদের ব্যাপারে তোমাদেরকে সদুপদেশ দিচ্ছি, তোমরা আমার উপদেশটি গ্রহণ করো। কেননা তারা তোমাদের সহযোগী এতদভিন্ন তাদের উপর তোমাদের কোন অধিকার নেই। তবে তারা যদি স্পষ্ট কোন অশ্লীলতায় লিপ্ত হয় তাহলে ভিন্ন কথা। (তিরমিযী, হাদীস: ১০৮৩, ৩০১২)

এ ভাষণে আরো এরশাদ করেছেন, হে মানবমন্ডলী! তোমাদের নারীদের প্রতি তোমাদের কিছু কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে, তোমরা আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদের গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে তাদেরকে তোমরা হালাল করে নিয়েছ। হে মানব মন্ডলী! তোমরা আমার কথা হৃদয়ঙ্গম কর, আল্লাহর বানী তোমাদের কাছে পৌঁছায়ে দেয়ার কাজ আমি সম্পন্ন করেছি। আমি তোমাদের নিকট এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারন করে থাক তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। সুস্পষ্ট আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। (সীরাত ইবনে হিশাম, খন্ড: , পৃ: ১৯০১৯১)

স্ত্রীর অধিকার প্রসঙ্গে নবীজির বাণী: হযরত মুআবিয়া ইবনে হায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের উপর স্ত্রীর অধিকার কী? নবীজি এরশাদ করেন, তুমি যখন খাবে তাকে খাওয়াবে, তুমি যখন কাপড় পরিধান করবে তাকেও পোশাক পরিচ্ছদ পরাবে। স্ত্রীর চেহারায় আঘাত করবেনা, গালমন্দ করবেনা, স্ত্রীর নিকট খারাপ কিছু দেখলে তাকে ঘরের মধ্যে রেখে তুমি অন্য বিছানায় ঘুমাবে। (আবু দাউদ, হাদীস: ১৮৩০)

বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় স্ত্রীর মাঝে অপ্রীতিকর বেহায়াপনা কিছু দেখতে পেলে তাকে সতর্ক ও সংশোধন করার প্রত্যয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ তাকে মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তার কক্ষ পরিবর্তন করে দাও। প্রয়োজনে তার থেকে আলাদা ঘুমাও।

নেককার স্ত্রী আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত: নারীরা পুরুষের সহযোগী সহায়ক শক্তি প্রেরণা সৃষ্টিকারী। এ পৃথিবীতে যত সাফল্য উন্নয়ন অগ্রগতি উন্নতি সব কিছুতেই পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে নারী জাতির বিশেষ ভূমিকা ও অবদান। নারী জাতির উৎসাহ ও প্রেরণা পুরুষের সাফল্য ও অর্জন তরন্বিত করেছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহু ইবনে আমর উবনুল আস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, গোটা পৃথিবীর সবটুকুই সম্পদ সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো নেককার নারী। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩১৮০)

নারী জাতি গৃহের তত্বাবধায়ক: স্বামীর গৃহে সন্তানের লালন পালন সুন্দর আচরণ শিক্ষাদান পারিবারিক পরিমন্ডলে সুচারুরূপে কার্য সম্পাদনে নারী জাতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের আদর্শ ও চরিত্র গঠনে মা জাতির ভূমিকা অপরিসীম। মাতৃক্রোড়ই শিশু সন্তানের পাঠশালা নিজ ছেলে সন্তানকে ছোটকাল থেকে ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নীতি নৈতিকতা, সততা, ভদ্রতা, নম্রতা, উত্তম শিক্ষা ও কল্যাণকামীতা শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে নারী জাতির বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের উজ্বল ও সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মানে কার্যকর ভূমিকা পালনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। নি:সন্দেহে মা জাতির ঘরের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, স্বামীর সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, সঠিক ব্যবহারে স্ত্রীর ভূমিকা নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নারী তার স্বামীর ঘরের তত্বাবধায়ক।” (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৮৪৪)

ইসলাম মানব জাতিকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অধিকারের স্বীকৃতি। পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হলো মানুষ। আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম এর মাধ্যেমে পৃথিবীর সর্বত্র মানব জাতির বংশ বিস্তার। পৃথিবীর সূচনাতেই প্রতিনিধি হিসেবে পুরুষের স্বীকৃতির সাথে সাথে নারী জাতিও স্বীকৃতির মর্যাদা পেয়েছে।

নারী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাশ্চ্যত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ নয় ইসলামী সভ্যতাই নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষনের একমাত্র আদর্শিক পাঠশালা।

আল্লাহ আমাদের নারী জাতির হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ রেজাউল করিম

জয়নগর, চকবাজার, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মদীনা শরীফে অবস্থিত উহুদ পাহাড়ের ফযীলত সম্পর্কে জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: মদীনা মনোওয়ারার উত্তরে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দূরে উহুদ পাহাড় অবস্থিত যা সমতল ভূমি থেকে ৩৫০ মিটার উচু। এর প্রশস্ততা প্রায় ১শ থেকে ৩শ মিটার। উহুদ শব্দের অর্থ এক বা একক। সোহাইলীর বর্ণনা মতে এ পাহাড়ের মর্যাদা অন্য পাহাড় থেকে স্বতন্ত্র বা একক, এ জন্যই উহুদ নামে নামকরণ হয়েছে। এক বর্ণনায় মদীনা শরীফের তিন মাইলের ব্যবধানে অন্যান্য পাহাড় থেকে এ পাহাড়টি বিচ্ছিন্নভাবে একাকী অবস্থিত হওয়ায় এ নামে প্রসিদ্ধ। বুখারী শরীফে বর্ণনা এসেছে, নবীজি এরশাদ করেছেন, এটি এমন একটি পাহাড় যেটি আমাদেরকে ভালবাসে আমরাও একে ভালোবাসি। পাহাড়ের মধ্যেও রাসূলুল্লাহর প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। নবীজি সমগ্র সৃষ্টি রাজির প্রতি প্রেরিত এটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। একদা উহুদ পাহাড়ে নবীজি আরোহন করলে পাহাড়ে কম্পন শুরু হলো নবীজি পাহাড়কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন, হে উহুদ পাহাড় থেমে যাও! কেননা তোমার উপর নবী ও শহীদ আরোহন করেছে। (সহীহ বুখারী)

এ স্থানে কাফিরদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধের নাম উহুদ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সত্তরজন সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাত বরণ করেছেন। নবীজি প্রতি বৎসর উহেুাদের শহীদগণের কবরে গিয়ে যিয়ারত করতেন ও তাঁদেরকে সালাম দিতেন।(খোলাসা, পৃ: ২০৪, মদীনাতুর রাসূল কৃত: আবু নসর মনজুর আহমদ, পৃ: ৩৩৬)