প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। কুরআন সুন্নাহর বিধান অনুসরণ করুন। জেনে রাখুন! প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভয়াবহ বন্যা, মহাপ্লাবন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো সুনামি মহামারী ক্ষুধা দারিদ্র সম্পদের ক্ষয় ক্ষতি জানমালের ক্ষতি, ক্ষেত খামার ফসলের ক্ষতি এ সবই বান্দার কর্মের প্রতিফল। আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ। এতে রয়েছে খোদাভীরু ধৈর্যশীল মু’মিন বান্দাদের জন্য করণীয় দায়িত্ব পালনের ঈমানী পরীক্ষা। সুখ দুঃখ বিপদাপদ আনন্দ বেদনা অভাব অনটন সচ্ছলতা অসচ্ছলতা সুস্থতা অসুস্থতা সর্বাবস্থায় মু’মিন বান্দারা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। অনুকূল প্রতিকূল স্বাভাবিক অস্বাভাবিক কঠিন ক্রান্তিকালেও তারা তাদের ঈমানী দায়িত্ব পালনে অটল অবিচল ও সক্রিয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের প্রায় ১৪টি জেলার ৬০ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৩০ জনের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানি বন্দী হয়ে আছে, খাদ্য বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রীর অভাব পূরণে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এদেেেশর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার ছাত্রবৃন্দ আলেম ওলামা বিভিন্ন সংস্থা সংগঠন পেশাজীবি মহল ব্যবসায়ী মহল শিক্ষক সমাজ সর্বস্তরের দেশ প্রেমিক মানুষের পক্ষ থেকে বন্যার্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে আর্ত মানবতার সেবায় যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছে তা প্রমাণ করে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।
আল কুরআনের আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানবতার পরিচয়:
ইসলাম মানবতার ধর্ম, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির পাশে দঁড়ানো নিঃসন্দেহে পুণ্যের কাজ। ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলামের এক অনুপম শিক্ষা। ভ্রাতৃত্ববোধ মমত্ববোধ ও মানবিকতা যে কোনো সমস্যাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে উৎসাহিত করে। ইসলাম যে কোনো ভালো কাজে পারস্পরিক সহায়তা ও সহযোগিতা করাকে উৎসাহিত করেছে। তবে অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন মূলক পরস্পর সহযোগিতা ও সমর্থন করাকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা সৎকর্ম ও ধার্মিকতায় পরস্পরের সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অন্যের সহায়তা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। অবশ্যই আল্লাহ শাস্তিদানে অতি কঠোর। (সূরা: আল মায়িতা, ৫:২)
যারা অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত বিপদগ্রস্ত এতিম, মিসকীন ও বন্দিদের খাদ্যদান করে তাদের প্রতি সহায়তা প্রদর্শন করে তাদেরকে মু’মিন হিসেবে চিত্রিত করেছেন। মহান আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে এরশাদ করেছেন, “তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্বেও মিসকিন এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে। (সূরা: আদ্ দাহর, ৭৬:৮)
হাদীস শরীফের আলোকে বন্যার্ত অসহায় মানুষের সাহায্য করা মু’মিনের পরিচয়:
ইসলামের শিক্ষা হলো সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর বান্দা! ইসলাম ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে, সকলের মাঝে শান্তি সাম্য সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের শিক্ষা দেয়। পরস্পর দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষ অশান্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। সকল মানবজাতি একই পরিবারভূক্ত হিসেবে ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে দেশ জাতি ও সমাজের কল্যাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন ও ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারের ন্যায়। (শুআবুল ঈমান, হাদীস: ৭০৪৮)
সৃষ্টির প্রতি দয়া করলে আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন:
কেবল মানুষ নয়, বৃক্ষরাজি তৃণলতা পাহাড় পর্বত নদনদী গবাদি পশু প্রাকৃতিক সম্পদ উদ্ভিদ রাজি প্রতিটি আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সদয় হওয়া বাঞ্চনীয়। পরিবেশ দূষণ, বৃক্ষ নিধন, নদী নালা অপরিচ্ছন্ন ও আবর্জনায় দূষিত করণ ইসলাম কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণী জগত ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সঠিক পরিচর্যা উপরন্ত সৃষ্টি রাজির প্রতি সদয় হওয়া আবশ্যক। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যারা দয়া করে আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবী বাসীর প্রতি দয়া করো আকাশবাসী আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (সুনানু আবী দাউদ, হাদীস: ১৯২৪)
দুর্গত মানুষের দুঃখ দূর করলে আল্লাহ তার দুঃখ দূর করবেন:
আজ দেশের লাখো লাখো বন্যার্ত মানুষ পানি বন্দী চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে, সমস্যা ও সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পানির উচ্চতা এতো তীব্র বাড়ির ছাদ অতিক্রম করেছে, অনেকে সন্তান হারা হয়েছে স্ত্রী স্বামী হারা হয়ে বিধবা হয়েছে, স্বীমী স্ত্রী হারা হয়েছে ছেলে পিতা হারিয়ে এতিম হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দিশেহারা হয়ে পড়েছে, স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণকে নিজ নিজ সামর্থানুসারে এগিয়ে আসা কর্তব্য। সমাজের বিত্তবান ব্যবসায়ী চাকুরীজীবি পেশাজীবী ও ছাত্র সমাজ দলমত নির্বিশেষে বন্যার্তদের সহায়তায় যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে তা জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে যার যা সামর্থ তা নিয়ে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী, শুকনা খাবার, ঔষধপত্র, জামাকাপড় নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দূর্গত এলাকায় হাজির হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছে তা ইসলামের অনুপম শিক্ষা। হাদীস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মুসলমান পরস্পরের ভাই। অতএব সে তার ওপর কোনো প্রকার জুলম করতে পারেনা। এবং তাকে অসহায় অবস্থায়ও ফেলতে পারেনা। আর যে তার মুসলমান ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের দু:খ দুর্দশা দূর করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিবসে তার ক্রটিও ঢেকে রাখবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৪৪২)
প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রাখা ও কষ্ট দানকারী ব্যক্তি মু’মিন হতে পারে না:
প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরন করা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সুখে দুঃখে পাশে থাকা, প্রতিবেশীকে কথায় কাজে আচরণে ব্যবহারে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা মু’মিনের পরিচায়ক। প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা, তার প্রতি অবিচার জুলুম নির্যাতন করা, প্রতিবেশিকে কষ্ট দেয়া, কারণে অকারণে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া ফাসাদ করা, প্রতিবেশীর প্রতি ভয়ভীতির সঞ্চার করা, শক্তি প্রদর্শন করা, প্রতিবেশীর অধিকার ক্ষুন্ন করা, মান সম্মান বিনষ্ট করা, প্রতিবেশীর জায়গা জমি অন্যায়ভাবে দখল করা, তার সম্পদ আত্মসাৎ করা, অন্যায় ভাবে ভোগ করা, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবেশীকে উচ্ছেদ করা, তার সম্পদ লুণ্ঠন করা, প্রতিবেশীর ব্যাপারে কুৎসা রটনা করা, প্রতিবেশির সুনাম ও ঐতিহ্য সহ্য করতে না পারা, প্রতিবেশীর ব্যাপারে মিথ্যা অপপ্রচার করা, প্রতিবেশী বিপদগ্রস্ত হলে আনন্দিত হওয়া, অতীব ঘৃণিত ও নিন্দনীয় চরিত্র। ইসলাম তা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এসব চরিত্রের লোকগুলো মু’মিন হতে পারে না। বন্যার্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো কারো আত্মীয় স্বজন, কারো প্রতিবেশী সর্বোপরি একজন মুসলিম বা অমুসলিম। ইসলাম অমুসলিমের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। মানুষ হিসেবে কারো প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি না করে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সংকটাপন্ন বিপদগ্রস্থ ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান গ্রহণ করেছে এবং পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করেছে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬০১৮)
আরো এরশাদ হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি পেট ভর্তি খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে মু’মিন নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস: ৪৯৯১)
দুর্গত বান্দাদের দান সাদকা করা:
বন্যার্ত বিপদ গ্রস্ত বান্দাদেরকে সাহায্য করার এটা উপযূক্ত সময়। প্রয়োজনীয় ত্রান সামগ্রীর পাশাপাশি অর্থ সহায়তা করা, বিধ্বংস্ত বাড়ীঘর নির্মাণে অর্থ সহযোগিতা করা পুণ্যময় নেক কাজ হিসেবে গণ্য হবে। তাদেরকে দান সাদকা করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অবলম্বন হিসেবে গন্য হবে। মহান আল্লাহ এ কাজের উত্তম প্রতিদান দেবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখনই আল্লাহর বান্দারা প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ করে তখনই দুজন ফিরিস্তা অবতীর্ণ হন তন্মধ্যে একজন বলতে থাকেন হে আল্লাহ তুমি দাতা ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও, অন্যজন বলতে থাকেন হে আল্লাহ কৃপন ব্যক্তিকে ধ্বংস করো। (বুখারী ও মুসলিম), হে আল্লাহ আমাদেরকে বন্যার্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমীন
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।