জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ বদিউল আলম রিজভি

| শুক্রবার , ৩ মে, ২০২৪ at ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ

বিষয় : শিশুর নামকরণ প্রসঙ্গ: ইসলামী নির্দেশনা

আল কুরআনের আলোকে অর্থবহ নাম রাখার গুরুত্ব: ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন দর্শন, মানব জাতির জন্য ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির জন্য সকল বিষয়ে সুন্দর ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নারী পুরুষ আল্লাহর সৃষ্টি। মানবজাতির মধ্যে নারী পূরুষের পারস্পরিক সম্মান মর্যাদা শ্রেষ্টত্ব ও মূল্যায়ন নিরুপণ করার জন্য মহান আল্লাহ দিয়েছেন কল্যাণকর নির্দেশনা, খোদা প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করলেই মানবজীবনে রয়েছে সুখ শান্তি সম্মান মর্যাদা ও যথার্থ মূল্যায়ন, পক্ষান্তরে খোদায়ী বিধান অমান্য করে একে অপরের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, দোষারোপ করা, মন্দনামে ডাকা, বিকৃত উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা ইসলামী আদর্শ ও আল কুরআনের নির্দেশনা পরিত্যাগ করার নামান্তর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে মু’মীনগন কোনো পক্ষ (পুরুষ) যেন অপর পক্ষ (পুরুষ) কে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারীর অপর কোনো নারীকেও যেন উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করবেনা এবং একে অপরকে মন্দ নামে আহবান করবেনা ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ। যারা তাওবা না করে তারাই জালিম। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১১)

বর্ণিত আয়াতে মানবজাতিকে অনেকগুলো দোষণীয় মন্দ স্বভাব পরিত্যাগ করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে, মানুষ কখনো একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে, ব্যক্তির প্রতি সম্মান ও সুন্দর আচরণ করা ভালো ব্যবহার করা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সদাচরন করা ইসলামী রীতি ও নবীজির শিক্ষা। ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা নাম বিকৃত করে খারাপ উপাধি দিয়ে সম্বোধন করা, সন্দেহ প্রবণ হয়ে নির্দোষ মানুষকে অভিযুক্ত করা, কারো ব্যাপারে কুধারণা পোষণ করা। কাউকে নিয়ে উপহাস করা ও দোষারোপ করা খুবই গর্হিত কাজ। বর্ণিত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের ঈমানী অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্য ঈমানের প্রকৃত তাৎপর্য ও মমার্থ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মুসলিম সমাজের ভ্রাতৃত্ববোধ মমত্ববোধ নৈতিকতা মানবিকতা ও মহানূভবতা জাগ্রত রাখার জন্য মনস্তাত্ত্‌্িবক আচরণ বিধি হিসেবে আয়াতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ।

সমাজে অনেক ধনী, সবল, সুঠাম, সুদর্শন, মেধাবী, দক্ষ পুরুষেরা দরিদ্র, দুর্বল, কুৎসিত, অমেধাবী, অদক্ষ, পুরুষকে উপহাস করে থাকে। হয়তো মানুষ জানেনা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন, তিনি তাঁর বান্দাকে কোন উপকরণ বা গুণ দিয়ে মূল্যায়ন করবেন সুতরাং পরস্পর বিদ্রুপ করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। নারী হোক পুরুষ হোক যাকে বিদ্রুপ করা হয়, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে বিদ্রুপকারী বা বিদ্রুপকারিনীর চেয়ে ভালোও হয়ে যেতে পারে, প্রত্যেক মু’মিনের কর্তব্য হলো তাঁর দ্বীনি ভাইয়ের ব্যাপারে কলংক লেপন করা বা দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকা।

নবজাতকের সুন্দর নাম রাখা পিতা মাতার কর্তব্য: মুসলিম পিতা মাতার কর্তব্য হলো আধুনিকতার ছোয়ায় নিজকে ভাসিয়ে না দিয়ে ভেবে চিন্তে প্রয়োজনে ইসলামী চিন্তাবিদ আলেমেদ্বীনের পরামর্শক্রমে নিজের সন্তানের সুন্দর নাম নির্বাচন করা। এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, পিতার উপর নবজাতকের অধিকার হলো, তার জন্য সুন্দর নাম রাখা।

সপ্তম দিনে শিশুর নামকরণ করা উত্তম: হাদীস শরীফে নবজাতকের আকীকা ও নাম করণের বিষয়ে এরশাদ হয়েছে, হযরত সামুরা ইবন জুন্দব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে প্রাণী জবেহ করবে, তার নাম রাখবে, তার মাথা মুন্ডন করবে। (তিরমিযী হাদীস: ১৫২২)

সুন্নাত হলো ছেলে সন্তান হলে দুটি ছাগল মেয়ে সন্তান হলে একটি ছাগল আকীকা করবে। জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা উত্তম। সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে চতুদর্শতম দিনে তাও সম্ভব না হলে একুশতম দিনে আকীকা করবে। (আল মুস্তাদরাক, হাদীস: ৭৫৯৫)

শরীয়তের দৃষ্টিতে সন্তান জন্ম লাভের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে যে পশু জবেহ করা হয় তাকে আকীকা বলে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৩৫৫)

যার আকীকা করা হয়নি সে যৌবনে বা বৃদ্ধাবস্থায়ও আকীকা করতে পারবে। (ফতোওয়ায়ে রযভীয়া, খন্ড: ২০, পৃ: ৫৮৮)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত ঘোষনার পর নিজের আকীকা করেছেন। (মুসান্নিফে আবদুর রাজ্জাক, ৪র্থ খন্ড, হাদীস: ২১৭৪)

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (.) বর্ণনা করেন, ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য কমপক্ষে একটি ছাগল হতে হবে। ছেলের জন্য দুটি হওয়া উত্তম। দুটি দেয়ার সামর্থ না থাকলে একটিই যথেষ্ট। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, খন্ড:২য়, পৃ: ৫৮৬)

মাসআলা: শিশু জন্মের পর মারা গেলে দাফনের পূর্বে তার নামকরণ করবেন। (রদ্দুল মোহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:১৬)

শিশু মৃত জন্ম গ্রহণ করলে তার নাম রাখার প্রয়োজন নেই, নাম রাখা ছাড়া দাফন করবে। (আলমগীরি, খন্ড:, পৃ: ৩৬২, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:১৬)

আকীকার ক্ষেত্রে সুন্নতের অনুসরনে সাওয়াবের নিয়্যতে সাদাসিদেভাবে পালন করা উচিত। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন, গান বাজনা ইত্যাদি অনৈসলামিক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা গর্হিত কাজ। এতে সওয়াব তো দূরের কথা আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্টির কারণ হবে।

নবীগণের নামে শিশুদের নামকরণ করবে: আল্লাহর রহমত বরকত ও কল্যাণ লাভের প্রত্যাশায় শরীয়ত সম্মত পন্থায় সুন্দর অর্থবহ নামরাখা বাঞ্চনীয়। সম্মানিত সাহাবাগণ ও আল্লাহর অলীগনের নাম অনুসরনে নাম রাখা হবে নিরাপদ ও বরকতময়। হাদীস শরীফে এরশদ হয়েছে, “কিয়ামতের দিন তোমাদের ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে এ কারণে তোমাদের উত্তম নাম রাখ। (আবু দাউদ হাদীস, ৪৯৪৮, শুআবুল ঈমান হাদীস: ৮২৬৫)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা নবীগণের নামে শিশুদের নামকরণ করবে, আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় নাম হলো আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান। (আবু দাউদ, হাদীস: ৪৯৫০)

মুহাম্মদ নাম রাখার ফযীলত: মুহাম্মদ নাম এমন বরকতময় পবিত্র কুআনে এ নাম চারবার উল্লেখ হয়েছে। অসংখ্য হাদীস শরীফে এ নামের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইমাম ইবন আসাকির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যার ছেলে সন্তান জন্ম নিল তার নাম মুহাম্মদ নামকরণ করল এ নামের বরকত লাভের জন্য, তাহলে সে ব্যক্তি এবং তার ছেলে দুজনই জান্নাতে যাবে। (কানযুল উম্মাল, খন্ড: ১৬, হাদীস: ৪৫২২৩, ফাতওয়ায়ে রজবীয়্যাহ, খন্ড: ২৪, পৃ: ২৮৬)

হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার তিনজন ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে সে তাদের মধ্যে কারো নাম মুহাম্মদ রাখলো না সে অবশ্যই অজ্ঞ (মূর্খ) (ইমাম তাবরানী, মু’জামুল কবীর, হাদীস: ১১০৭৭)

মাসআলা: নাম কুৎসিত হলে পরিবর্তন করে উত্তম নাম রাখা নবীজির সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন। (তিরমিযী, হাদীস: ২৮৩৯)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুর এক কন্যার নাম ছিল আছিয়া, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাম রাখলেন জামিলা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২১৩৯)

এভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকের কুৎসিৎ নামগুলো পাল্টে সুন্দর ও অর্থবহ নাম রেখেছেন। একব্যক্তির নাম ছিল আসরাম তার নাম পরিবর্তন করে যুরআ রেখেছেন। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:১৬)

মাসআলা: আবদুল মোস্তফা, গোলাম মোস্তফা, আবদুন নবী, আবদুর রাসূল নাম রাখা জায়েজ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:১৬)

নবী বিদ্বেষীরা বর্ণিত, নাম সমূহে শির্ক ও বিদআতের গন্ধ আবিস্কার করে যা তাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক।

মুহাম্মদ নামের বরকত: মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা এর শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আ’তা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছুক হয় যে, তার স্ত্রীর গর্ভের সন্তান ছেলে হোক তার উচিত তাঁর হাত গর্ভবতী স্ত্রীর পেটে রেখে বলা, যদি আমার ছেলে হয় তবে আমি তাঁর নাম মুহাম্মদ রাখলাম। ইনশআল্লাহ তাঁর ছেলেই হবে। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, ২৪তম খন্ড, পৃ: ৬৯০)

হযরত ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নাম, তাঁর পিতার নাম, দাদার নাম মুহাম্মদ ছিলো অর্থাৎ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম আবু হামীদ মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ গাযালী।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শিশুর নাম করণে ইসলামী নির্দেশনা অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি গাছ, একটি প্রাণ, একটি সুন্দর পৃথিবী
পরবর্তী নিবন্ধঅপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগও