জুম্‌’আর খুতবা

কুরআন হাদীসের আলোকে কবীরা গুনাহ’র বর্ণনা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কুরআনের আলোকে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকার সুসংবাদ:

যারা কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে তাদের জন্য ক্ষমার সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা যদি বড় বড় নিষিদ্ধ গুনাহগুলো থেকে বিরত থাক তাহলে আমি তোমাদের (অন্যান্য) পাপরাশি ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনকভাবে (জান্নাতে) প্রবেশ করাবো। (সুরা: আন নিসা, :৩১)

যারা অশ্লীল অপকর্ম ও বড় বড় গোনাহের কাজ থেকে নিজকে বিরত রাখবে, তাদের জন্য পরম করুণাময় দয়াবান আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও সম্মানের সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর সেসব ব্যক্তি যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ কর্ম থেকে দূরে থাকে এবং রাগান্বিত হলে ক্ষমা করে। (সূরা: আস শুরা ৪২: ৩৭)

হাদীস শরীফের আলোকে কবীরা গুনাহ: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়া আল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, “আল্লাহ তা’আলা যা কিছু নিষেধ করেছেন, তাই কবীরা গুনাহ। (তাবরানী, কাবীর, হাদীস: ২৯৩)

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (.)’র বর্ণনা মতে গুনাহ কবীরাহ ওইসব গুনাহকে বুঝানো হয় যার নিষেধাজ্ঞা কুরআন সুন্নাহর অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমানিত। অথবা যে গুনাহ করার কারণে শরীয়ত কর্তৃক শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে তাই কবীরা গুনাহ, অথবা ওইসব গুনাহ যা দ্বারা দ্বীনের প্রতি অশ্রদ্ধা অবজ্ঞা ও অসম্মান প্রকাশ পায় তা কবীরা গুনাহ। (মিরাআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৬৫)

কবীরা গুনাহের সংখ্যা: কবীরাহ গুনাহর সংখ্যা বর্ণনায় তাফসীরকার ও হাদীস বিশারদগনের বিভিন্ন মত রয়েছে ১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে কবীরা গুনাহর সংখ্যা ৭০টি। ২. হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনামতে কবীরা গুনাহের সংখ্যা ৭০০টি (মিরকাত) অথার্ৎ গুনাহে কবীরাহ গুণাহর প্রকার ৭০টি সংখ্যা ৭০০টি। (মিরআতুল মানাজীহ, শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃ: ৬৭ বঙ্গানুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান)

সাতটি ধ্বংসাত্মক কবীরা গুনাহ: অসংখ্যা হাদীস শরীফে কবীরা গুনাহ সংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা উল্লেখ রয়েছে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এর সংখ্যাগত ভিন্নতা আলোকপাত হয়েছে, নিম্নে বর্ণিত হাদীসে সাতটি জঘন্য কবীরা গুনাহ সম্পর্কে নবীজি সাবধান ও সতর্ক করেছেন, এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “সাত টি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বিরত থাকো, সাহাবাগন, আরজ করলে সেগুলো কি কি? তিনি এরশাদ করলেন আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদু করা, অন্যায়ভাবে এই ব্যক্তিকে হত্যা করা যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, সুদ ভক্ষণ করা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা, জিহাদের দিন পৃষ্ঠ প্র্রদর্শন (পলায়ন) করা, সহজ সরল সচ্চরিত্রবর্তী নারীদেরকে অপবাদ দেওয়া। (সহীহ বুখারী হাদীস, ২৫৬০)

শিরক হলো জঘন্য অপরাধ: সম্মানিত নবী রাসূলগণ আপন আপন উম্মতদের কে শিরক সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, হযরত লুকমান আলাইহিস সালাম কর্তৃক প্রদত্ত উপদেশ পরিবারের সকলের জন্য অনুস্মরণীয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, স্মরণ করুন, যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করোনা, নিশ্চয় শিরক হলো বড় যুলুম। (সূরা: লোকমান ৩১:১৩)

হাদীসের প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা:

যাদু করা, যাদু বিদ্যা শিক্ষা করা কবীরা গুনাহ। তবে যাদুর প্রভাব বিনষ্ট করার জন্য বা যাদুর ক্ষতি থেকে বেচে থাকার জন্য যাদু শেখা জায়েজ। যাদুতে কুফরী শব্দ থাকলে যাদুকর মুরতাদ হয়ে যাবে। এ ধরনের যাদুকর কে হত্যা করা ওয়াজিব। (আশি আতুল লুমআত)

সুদ ভক্ষন করা কবীরা গুনাহ:

সুদ গ্রহণ করা, সুদ প্রদান করা উভয়টিই কবীরা গুনাহ, সুদ দাতা ও সুদ গ্রহীতা সবার প্রতি আল্লাহ তা’আলা অভিসম্পাত করেছেন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদখোর, সুদ প্রদানকারী সুদী কারবারের সাক্ষী সুদের চুক্তি নামার লেখক ( এ চার শ্রেণির লোক কে) আল্লাহ তা’আলা অভিসম্পাত দিয়েছেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২২৭৭)

এতিমের মাল ভক্ষণ করা কবীরা গুনাহ:

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের ধন সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে তারা তো তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে। আর অচিরেই তারা প্রজ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে। (সূরা: নিসা: :১০)

ইয়াতীমের প্রতি সদাচরণ করা, তাদের সম্পদ সংরক্ষণ করা, তাদের প্রতি সযত্ন তত্ত্বাবধান করা, ঈমানের পরিচায়ক। তাদের প্রতি কঠোরতা আরোপ করা, তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সম্পূর্ণরূপে হারাম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, সুতরাং আপনি ইয়াতীমের প্রতি ধমক দিবেন না এবং ভিক্ষুককে বিতাড়িত করবেন না। (সূরা: দ্বোহা, ৯৩:১০)

ইয়াতীমের পরিচর্যাকারী নবীজির সাথে জান্নাতে যাবে:

হযরত সাহল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ইয়াতীমের পরিচর্যা করে আমিও সে একসাথে জান্নাতে থাকবো। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৩০৪)

কাফিরদের সাথে যুদ্ধ ময়দান থেকে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ:

কাফির মুশরিক ইয়াহুদী খৃষ্টানগণের সাথে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ না করে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ। ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত করার লক্ষ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করা যুদ্ধে অটল অবিচল থাকা, প্রয়োজনে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করা মু’মীনের পরিচায়ক। কিন্তু যুদ্ধ ময়দান থেকে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ।

অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা কবীরা গুনাহ:

অন্যায়ভাবে কোনো মু’মিনকে হত্যা করা, হত্যার পরিকল্পনা করা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকা হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করা, কবীরা গুনাহ আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মু’মীন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা: নিসা: :৯৩)

মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ:

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে মিথ্যা সকল পাপের মূল। আরো এরশাদ হয়েছে, সত্য মুক্তি দেয়, মিথ্যা ধ্বংস করে। সততা নৈতিকতা মু’মীনের আদর্শ চরিত্র ও উত্তম গুণ। পক্ষান্তরে মিথ্যাচার মুনাফিকের চরিত্র। মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ। এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবীরা গুনাহ সমূহের উল্লেখ করলেন অথবা তাঁর কাছে তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, অত:পর তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা প্রাণ হত্যা করা, পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া, অত:পর তিনি এরশাদ করেন, আমি কি? তোমাদের জানিয়ে দেব না? কবীরা গুনাহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক কোনটি? তিনি বলেন, মিথ্যা কথা বলা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারী, ৫৯৭৭)

হে আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফিক দিন। কবীরা গুনাহ থেকে আমাদেরকে বেচে থাকার তাওফিক দিন, আমীন।

অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ মিশকাতুল ইসলাম

চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গুনীয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মৃত পুরুষ বা মহিলার লাশবাহী খাট কাঁধে বহন করার নিয়ম ও ফযীলত সম্পর্কে জানালে কৃতার্থ হব।

প্রশ্নের উত্তর: মৃত ব্যক্তির লাশবাহী খাট কাঁধে নেওয়া ইবাদত ও সওয়াবের কাজ। কাঁধে নেওয়ার সুন্নাত পদ্ধতি হচ্ছে, একের পর এক চারটি পায়াকে কাঁধে নেয়া এবং প্রতিবারে দশ কদম করে চলা। প্রথমে মরহুম, মরহুমার মাথার দিকের ডান পাশ কাঁধে নিবে, এরপর ডান পায়ের ডান দিকের পাশ, অতঃপর মাথার দিকের বাম পাশ এবং সর্বশেষ পায়ের দিকের বাম পাশ কাঁধে বহন করবে এবং দশ কদম করে চলবে এতে মোট চল্লিশ কদম গণনা করবে। (আলমগীরি ১ম খন্ড, পৃ: ১৬২, বাহারে শরীয়ত ১ম, খন্ড: পৃ: ৮২২) জানাযার লাশবাহী খাট বহনে বা কাঁধে নেওয়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির খাট নিয়ে চল্লিশ কদম চলবে তার চল্লিশটি গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আরো এরশাদ হয়েছে যে ব্যক্তি চারটি পায়াকে কাঁধে নিবে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তা’আলা এ ফযীলত পূর্ণ আমলে শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

(আল জাওহারাতুন নায়ারাহ খন্ড: ১ম, পৃ: ১৩৯, দুররে মুখতার খন্ড: , পৃ: ১৫৯, বাহারে শরীয়ত খন্ড: ১ম, পৃ: ৮২৩)

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুহাম্মদ জামান হেডমাস্টার : অবিনশ্বর আলোকবর্তিকা
পরবর্তী নিবন্ধবিভাগীয় শ্রম পরিচালকের সাথে টিইউসি জেলা নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ