ইসলামে ইয়াতিমের অধিকার
ইয়াতিমের সংজ্ঞা : ইয়াতিম শব্দটি আরবি এর অর্থ একাকী নিঃসঙ্গ, ইসলামী শরয়ী পরিভাষায় যে শিশু সন্তানের পিতা ইন্তেকাল করেছেন তাকে ইয়াতিম বলা হয়। সন্তান-সন্ততি প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে ইয়াতিম বলা হয় না। শিশুকে তখনই নি:সঙ্গ বলা হয় যখন পিতা থাকেনা, সন্তানের ভরণ-পোষণ যাবতীয় ব্যয়ভার দায়িত্ব পিতার উপর অর্পিত হয়, পিতার উপস্থিতিতে মাতাবিহীন শিশুকে ইয়াতিম বলা হয় না। মাতার অবর্তমানেও শিশুর দায়িত্ব পিতার উপর। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইয়াতিম, বিশ্ব মানবতার নবী রাহমাতুল্লীল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় পিতা হযরত আবদুল্লাহ (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন মা জননী হযরত আমেনা খাতুন (রা.) ও ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের স্নেহে ও তত্বাবধানে তিনি লালিত পালিত হন।
ইসলামে পিতৃমাতৃহীন সন্তান-সন্ততির অধিকার : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পবিত্র ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অন্য কোন ধর্মে ইয়াতিম অনাথদের সম্বন্ধে মানবিক কোন নির্দেশনা নাই বললেই চলে। আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামেই ইয়াতিমদের অধিকার ও তাদের সামগ্রিক কল্যাণ চিন্তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইয়াতিমদের রক্ষণাবেক্ষণ, তত্বাবধান তাদের সম্পদ সংরক্ষণ, তাদের প্রতি সহানুভূতি, স্নেহ, মমতা, তাদের শিক্ষা দীক্ষা, ভরণ-পোষণ, সুন্দর পরিচর্যা, তাদের উন্নত জীবন গঠনে কল্যাণধর্মী চিন্তাভাবনার ব্যাপারে মহান আল্লাহ ও তদীয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতিকে যে অনুপ্রেরণা দিয়েছে তারই প্রেক্ষিতে পৃথিবীর দেশে দেশে ইয়াতিমদের পূনর্বাসনে সরকারী বেসরকারি পর্যায়ে অসংখ্য ইয়াতিম-অনাথ, দু:স্থ পনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইয়াতিমদের অভিভাবক : বিশ্ব মানবতার অগ্রদূত, কল্যাণের মূর্ত প্রতীক, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইয়াতিম, নি:স্ব, অসহায়দের একান্ত অভিভাবক। আল্লাহর দয়া অনুগ্রহে তিনি ইয়াতীমের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “(হে হাবীব) আপনি ইয়াতিমের প্রতি কঠোরতা গ্রহণ করবেন না এবং ভিক্ষুকদের কে ধমক দিবেন না। (৯৩ সূরা: দোহা, আয়াত: ৯-১০)
ইয়াতিম মিসকীনকে ভর্ৎসনাকারী লোকেরা হচ্ছে দ্বীনকে অস্বীকারকারী : মহান আল্লাহ তা’আলা ইয়াতিম-অনাথ মিসকীনদের ভৎসনাকারী লোকদেরকে দ্বীনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “(হে নবী) আপনি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন যে দ্বীনকে অস্বীকার করে সে তো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতিমকে রূঢ় ভাবে তাড়িয়ে দেয় আর সে মিসকীনদের খাবার দানে মানুষকে উৎসাহিত করেনা। (সূরা: মাউন, ১০৭, আয়াত: ১-৩)
ইসলাম ভালোবাসা ও মানবতার ধর্ম : মানবতার কল্যাণ ও সেবা করা ইসলামের অনুপম শিক্ষা। প্রিয়নবীর পদাঙ্ক অনুসারী সত্যের মাপকাঠি সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের প্রয়োজনের উপর ইয়াতিম, অসহায়, ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত, মানুষদেরকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দিতেন। তাদের কল্যাণে সবকিছু উৎসর্গ করে দিতেন। মহান আল্লাহতা’আলা এ অনুপম আদর্শকে মু’মিন জীবনের উত্তম আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করত: যারা ইয়াতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল তাদের প্রশংসা করেছেন এরশাদ হয়েছে, “তারা দুনিয়ার জীবনে খাদ্য দ্রব্যের প্রতি নিজেদের প্রয়োজন আসক্তি থাকা সত্বেও মিসকীন, ইয়াতিম ও কয়েদীদের সাহায্য প্রদান করে। (সূরা: দাহর, ৭৬:৮)
ইয়াতিমরা তোমাদের ভাই : নবীজি দারিদ্র পছন্দ করতেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিজের জন্য দারিদ্র বেছে নিয়েছেন। তাঁর কাছে চেয়ে কেউ বিমুখ হতো না। তিনি ছিলেন রাউফুর রহীম (দয়ার সাগর) তাদের অসুবিধায় তিনি হতেন চরম মর্মাহত, তাদের সুখ ও কল্যাণের পরম লোভী ছিলেন তিনি। (সূরা: তাওবা : ১২৮)
ইয়াতিমদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। ইয়াতিমদের জন্য ব্যয় করা, ইয়াতিমদের কল্যাণে তাদের পাশে থাকা, তাদের প্রতি সদাচরণ করা ছিল নবীজির মহত্তম আদর্শ। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে নবী! আর তারা আপনাকে ইয়াতিমদের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আপনি বলুন, তাদের সম্পদ সৎ উদ্দেশ্য পরিচালনা করা উত্তম। আর যদি তাদের সাথে একত্রে থাক, তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। (সূরা: বাক্বারা: ২২০)
ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা : সমাজের এক শ্রেণির অসৎ চরিত্রের লোকেরা ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করে অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করে। ইয়াতীমের সম্পদে নিজেদের অবৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, অযাচিতভাবে ইয়াতিমদেরকে তাদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে তাদের উপর জুলুম নির্যাতন চালায়। এসব অপকর্ম মু’মিনের চরিত্র হতে পারে না, এরা মানুষের নিকট ঘৃণিত, দুনিয়া আখিরাতে তারা অভিশপ্ত, জাহান্নাম তাদের আবাসস্থল। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যারা ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করে অন্যায়ভাবে তারা নিজেদের পেটে খেয়েছে আগুন। আর অচিরেই তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (৪: সূরা: নিসা: আয়াত:১০)
হাদীস শরীফের আলোকে ইয়াতীমের তত্ত্বাবধান করা: হযরত সাহল ইবন সা’দ (রা.) বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি এবং ইয়াতীমের ভরন-পোষনকারী কিয়ামতের দিন এইরূপ থাকব। একথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলীর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। [আল-আদাবুল মুফরাদ, কৃত: ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারী (র.)]
সর্বোত্তম গৃহ যে গৃহে ইয়াতিম আছে : যে মুসলমান কোন ইয়াতিমকে প্রতিপালন করবে, ইয়াতীমের অভাব পূরণ ও কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট থাকবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য সু-সংবাদ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুসলমানদের বাসগৃহের মধ্যে সেই গৃহই সর্বোত্তম যে গৃহে কোন ইয়াতিম আছে এবং তার প্রতি সদ্ব্যবহার করা হয় এবং মুসলমানদের বাসগৃহের মধ্যে সর্বনিৎকৃষ্ট গৃহ সেইটি যে ঘরে কোন ইয়াতিম আছে আর তার প্রতি দুর্ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমি এবং ইয়াতীমের ভরণ-পোষণকারী বেহেশতে এই দু’টির মত অবস্থান করব। এ কথা বলে তিনি তাঁর দুটি পবিত্র আঙ্গুলির প্রতি ইংগিত দিলেন।” (আল-আদাবুল মুফযাদ, পৃ: ৯২)
বিধবা ও ইয়াতিমদের প্রতিপালনের বিনিময় : কিয়ামতের কঠিন ভয়াবহ মুহূর্তে যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন ইয়াতীমের লালন পালনকারীকে আল্লাহ তা’আলা আরশের ছায়ার নীচে আশ্রয় দিবেন। এরশাদ হয়েছে, “হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন ইয়াতিম অথবা স্বামী বিহীন বিধবার ভরন-পোষনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামতের দিন তাঁকে স্বীয় আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন।” (তাবরানী, আল-মুজামুল আওসাতি, খন্ড: ৬, পৃ: ৪২৯, হাদীস: ৯২৯২)
ইয়াতিমের আশ্রয়দানকারীর প্রতিদান : হযরত সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম আরজ করেছিলেন হে প্রভূ! যে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কোন ইয়াতিম বা বিধবাকে আশ্রয় দিল তার প্রতিদান কী? আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন, তার প্রতিদান হলো আমি তাকে আমার আরশের ছায়ায় স্থান দিব যেদিন আমার আরশের ছায়াব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবেনা। [কিতাবুয যুহুদ, কৃত: আহমদ বিন হাম্বল, পৃ: ১০৫ হাদীস: ৩৬৩, তামহীদুল ফরশি ফী হিসালিল মু’জিবাতি লেযিল্লীল আরশি, কৃত: আল্লামা জালালুদ্দীন সূয়তি (র.)]
ইয়াতিমের প্রতি পিতৃসম সদয় হও : পিতৃস্নেহে পুত্র যে ভাবে পালিত হয়। পুত্র যে ভাবে পিতার দয়া আদর যত্ন স্নেহ লাভে ধন্য হয়ে থাকে ইয়াতীমের প্রতি অনুরূপ সদাচরণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারাও মানুষ তাদেরকে স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদেরকে আপন করে নিতে পারলে তারাও সুন্দর ও আনন্দময় আদর্শ জীবন লাভে সক্ষম হবে। হযরত দাউদ (রা.) বলেন, ইয়াতীমের জন্য পিতৃসদৃশ সদয় হও, জেনে রাখ! তুমি যেমন বপন করবে তেমন কর্তনও করবে, সচ্ছলতার পর অসচ্চলতা কতই মন্দ কথা, তারচেয়েও নিকৃষ্টতর হচ্ছে হিদায়ত লাভের পর গোমরাহী।
ইয়াতিমের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য : ইয়াতিম, দুস্থ, অসহায় মানুষগুলো তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাদের সুযোগ-সুবিধা, উন্নতি, অগ্রগতি, কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায় সহযোগী হতে পারলে আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ ও কৃপা অর্জনে আমরা সক্ষম হবো। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার, আল্লাহর নিকট প্রিয় সৃষ্টি হলো যে তার সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করে।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।