প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। জেনে রাখুন! শিরক হলো অমার্জনীয় অপরাধ। পৃথিবী থেকে শিরক নির্মূল করার জন্য আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করোনা। (আল কুরআন, ৪:৩৬)
কুফর, শির্ক ও মুর্তিপুজা থেকে বিরত রাখার জন্য আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য নবী–রাসূল পাঠিয়েছেন। সকলের আহবান ছিলো এক ও অভিন্ন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত প্রতিমাকে বর্জন করো।” (আল কুরআন, ১৬:৩৬)
নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তা’আলা ধরাধামে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন। তাঁর জাতির পথভ্রষ্ট অসভ্য লোকেরা নিজেদের স্বহস্তে নির্মিত মূর্তি ও প্রতিমাগুলোর উদ্দেশ্যে এমন সব কাজই করতো যা একমাত্র বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা আল্লাহর জন্য নিদ্দিষ্ট। তারা মূর্তিগুলোকে সিজদা করতো, সেগুলোকে কল্যাণ অকল্যাণের মালিক মনে করতো, তারা এক আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত হলো। তিনি তাদের ভ্রান্ত ধারণার তীব্র প্রতিবাদ করলেন, বিশ্বজাহানের প্রতিপালক ও মহান রাব্বুল আলামীনের একত্ববাদের দাওয়াত শুরু করলেন।
হযরত ইবরাহীম (আ.)’র জন্ম ও বংশ পরিচয়:
মহান আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণের মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আ.)’র নাম বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ২৫টি সূরার ৬৭ জায়গায় তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে, পবিত্র কুরআনে তাঁর নামে একটি সূরার নামকরণ হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.)’র উপাধি খলীলুল্লাহ। তিনি আল্লাহর বন্ধু উপধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি আদম (আ.) হতে ৩৩৩০ বছর পর ইরাকের অন্তর্গত বাবেল অঞ্চলের “কুছা” মতান্তরে বালদানিয়া শহরের “উর” নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। এক বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ.) ছিলেন নূহ (আ.)’র এগারোতম অধঃস্থন পুরুষ। নূহ (আ.) থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত ২০০০ বছরের ব্যবধান, হযরত সালেহ (আ.)’র প্রায় ২০০ বছর পর পৃথিবীতে হযরত ইবরাহীম (আ.)’র আগমন ঘটে। তাঁকে “আবুল আম্বিয়া” তথা নবীগণের পিতা বলা হয়। তাঁর স্ত্রী “সারা” ছিলেন, “উম্মুল আম্বিয়া” বা নবীগনের মাতা।
হযরত ইবরাহীমের (আ.) অসংখ্য গুণাবলী:
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ হয়েছে। ইবরাহীম (আ.) এর পরবর্তী সকল নবী আলাইহিমুস সালাম তাঁর বংশ থেকেই এসেছেন। হযরত আদম (আ.) হতে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী ব্যাতীত সর্বশেষ নবী ইমামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে শুভাগমন করেছেন হযরত ইবরাহীম (আ.)’র সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.) এর বংশ থেকে। অতএব ইবরাহীম (আ.) জাতির পিতা একই ভাবে তাঁর পরবর্তী আল্লাহর প্রেরিত নবীগণেরও পিতা।
পবিত্র কুরআনে ইবরাহীম (আ.)’র আলোচনা:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.)’র উত্তম আদর্শ, তাঁর আক্বিদা বিশ্বাস, চারিত্রিক গুণাবলী, শির্ক, মূর্তি পুজা ও তারকা পূজারীদের বিরুদ্ধে তাঁর আপোষহীন মনোভাব ও দ্বীনি দাওয়াত প্রচারে তাঁর ভূমিকা আলোকপাত হয়েছে। সকল নবী রাসূল এর জীবনাদর্শ ছিলো অনুপম সুন্দর ও অনুসরণীয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমাদের জন্য ইবরাহীম এবং তাঁর সঙ্গীদের মাঝে রয়েছে আদর্শ। (সূরা, মুমতাহিনা: ৪)
ইবরাহীম (আ.) ছিলেন সত্যের প্রচারক “হানিফ” একনিষ্ঠ বিশ্বাসী:
পবিত্র কুরআনে “হানিফ” শব্দটি বারো বার উল্লেখ হয়েছে। তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়ে এসেছে আট বার, “হানিফ” অর্থ শিরক থেকে মুক্ত, একত্ববাদে বিশ্বাসী, একনিষ্ট মুসলিম, সহজ সরল সঠিক পথে অটল, অবিচল, স্থির, আপোষহীনভাবে সত্য গ্রহণকারী। মহান আল্লাহ তাঁর গুনাবলী প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ইহুদী ছিল না, খ্রিস্টানও ছিল না, সে তো ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না কখনোই। (সূরা, আলে ইমরান: ৬৭)
ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক বাদশাহ নমরূদকে দ্বীনের দাওয়াত:
ইবরাহীম (আ.) যে জাতির নিকট নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন সে জাতির বাদশাহর নাম ছিল “ নমরূদ” সে ইরাকের বাবেল শহরে বসবাস করত। তাঁর রাজত্ব পূর্ব হতে পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল। সে কঠোর স্বেচ্ছাচারী জালিম বাদশাহ ছিল। সে প্রায় চারশত বছর রাজত্ব করে। তাঁর সময়ে অগ্নিপূজার প্রচলন হয়। এখানকার লোকেরা মূর্তি পুজা করতো, হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁকে হিদায়াতের দাওয়াত মূর্তিপূজা ও শিরকি কাজ পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানালেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ইবরাহীম বললেন তবুও কি তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুর উপাসনা করবে যা তোমাদের কোনো উপকারও করতে পারে না এবং তোমাদের ক্ষতিও করতে পারে না। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৬৬)
নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম দুনিয়ার কোনো তাগুতি শক্তিকে ভয় করেন না। সকল প্রকার ভয়ভীতি ও রাষ্ট্রীয় চক্রান্তকে পদদলিত করে তাঁরা আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করার জন্য নিজেদের চূড়ান্তভাবে উৎসর্গ করেন। সকল প্রকার প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতা ব্যর্থ করে দিয়ে তাঁরা দ্বীনের আওয়াজকে বুলুন্দ করেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন, সত্যের বাণীকে সমুন্নত করেন। নবী রাসূলগণের মোকাবিলায় কাফির মুশরিকদের সকল প্রকার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে যায়। ইবরাহীম (আ.) বাদশাহ নমরূদকে ইসলামের দাওয়াত দেন, অকাট্য সুস্পষ্ট প্রমাণাদি ও যুক্তি প্রমানের আলোকে ইসলামের সত্যতাকে তুলে ধরেন। সীমালঙ্ঘনকারী অত্যাচারী শাসক নমরূদ আল্লাহর নবী ইবরাহীম (আ.) এর সাথে যুক্তি তর্কে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ইবরাহীম (আ.) কে জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার মহা পরিকল্পনা করে অবশেষে নমরূদের নির্দেশে জলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় হযরত ইবরাহীম (আ.) সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আগুনের কাজ তো ভস্মিভূত করা, জালিয়ে ফেলা, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সেদিন আল্লাহর নবী ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম এর জন্য গুলজার তথা ফুল বাগানে পরিণত হলো। নমরূদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ হলো স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী ইবরাহীম (আ.)’র সাহায্যকারী ও ত্রানকর্তা হিসেবে তাঁকে হিফাজত করলেন, আগুনের শক্তি স্তব্ধ হয়ে গেল আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি নির্দেশ দিলাম হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীম (আ.)’র প্রতি শীতল ও নিরাপদ হও। (সূরা: আম্বিয়া, ৬৯)
ইবরাহীম (আ.)’র সাথে যুক্তি তর্কে নমরূদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো:
সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত মিথ্যা তো অপসৃত হবারই। খোদাদ্রোহী নবী দ্রোহী কাফির মুশরিকদের লাঞ্চনা অসম্মান অপমান অবধারিত ও সুনিশ্চিত। মিথ্যাবাদীরা তাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে যুক্তি তর্কে পরাজিত হলে আবেগের শিকার হয়ে থাকে। অভিশপ্ত নমরূদও ঠিক তাই করেছিল। আল্লাহ তা’আলা জালিম নমরূদের পরিণতি প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, তুমি কি দেখনি সে লোকটিকে যে ইবরাহীম (আ.)’র সাথে তাঁর পালন কর্তার ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল এ কারণে যে আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন? যখন ইবরাহীম বলল আমার পালনকর্তা তিনি যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, তখন সে বলল আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি ইবরাহীম বলল আল্লাহ তো সূর্য কে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন পারলে তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফির হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী লোকদের সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা: বাক্বারা: ২৫৮)
জালিম নমরূদ জীবন মৃত্যেুর প্রকৃত দর্শন অনুধাবনে ব্যর্থ হলো। বর্ণিত আছে, সম্ভবত এ জন্যই নমরূদ তখন জেলখানা থেকে দুই কয়েদিকে এনে একজন কে হত্যা করে আপরজন কে মুক্ত করে দেয়। এ দাম্ভিক বোকার অজ্ঞতা দেখে ইবরাহীম যুক্তির পট পরিবর্তন করলেন। তিনি বললেন আমার আল্লাহ তো সূর্য কে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি যদি সৃষ্টিকর্তা হয়ে থাক, পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। এতে তার দম্ভচূর্ণ হয়ে গেল, যুক্তি তর্কে শোচনীয় পরাজয়ের পরও ইবরাহীম (আ.) এর উপর ঈমান আনে নি, অবশেষ মহান আল্লাহ তাঁর ক্ষুদ্র একটি সৃষ্টি একটি মশাকে তার নাসিকায় প্রবেশ করিয়ে মশার কামড় ও যন্ত্রণায় তার মৃত্যু ঘটান। চল্লিশ বছর শাস্তি ভোগ করার মধ্য দিয়ে প্রায় চারশত বছর বয়সে নমরূদের মৃত্যু হয়। (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ: ৬৮)
হাদীস শরীফের আলোকে “মিল্লাতে ইবরাহীম” সঠিক পথ:
মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে মিল্লাতে ইবরাহীম অনুসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দীয় দ্বীন কোনটি? তিনি বললেন সহজ সরল হানিফিয়্যাহ, (মিল্লাতে ইবরাহীম) [সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, পৃ: ৯৩)
প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন ইবরাহীম (আ.) এর দুআর ফসল:
পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূলগণ সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আগামী বার্তা প্রচার করেছেন, নবীজি এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে আমার জীবনের সূচনা সম্পর্কে বলব, আমি হলাম ইবরাহীম (আ.)’র দুআ। ঈসা (আ.)’র সু–সুংবাদ ও আমার আম্মাজানের স্বপ্ন। (তাফসীরে বগভী, ১/৫১)
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) ২০০ বছর মতান্তরে ১৯৫ বা ১৭৫ বছর হায়াত লাভ করে ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ১০/১২ মাইল দূরবর্তী হেবরন এলাকায় তাঁর রওজা শরীফ অবস্থিত। বর্তমানে এ এলাকা “মদীনাতুল খালীল” নামে পরিচিত। (নববী, তাহযীবুল আসমা, ১ম খন্ড, পৃ: ১০২)। হে আল্লাহ! আমাদেরকে মিল্লাতে ইবরাহীম এর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আনোয়ারুল আজীম
ফয়েজলেক, খুলশী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কুরআন ও হাদীসের মধ্যে পাথর্ক্য কি? সংক্ষেপে জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: কুরআন আল্লাহর বাণী। হাদীস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বাণী। কুরআন জিব্রাইল (আ.) মাধ্যমে অক্ষর ও শব্দসহ অবতীর্ণ কিতাব। কিন্তু হাদীস জিব্রাইল (আ.)’র মাধ্যমে হওয়া শর্ত নয়।
কুরআন হলো ওহীয়ে মাতলু (পঠিত ওহী) নামাযে অবশ্যই কুরআন তিলাওয়াত করতে হয়। হাদীসকে বলা হয় ওহীয়ে গাইরে মাতলু (অপঠিত ওহী) নামাযে হাদীস পঠিত হয় না। কুরআন অস্বীকারকারী কাফির। হাদীস অস্বীকারকারী গুনাহগার ও পথভ্রষ্ট। তাফসীরকার ও ইমামগণের সর্বসম্মত মত হলো সমগ্র সুন্নাহ ও হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা। (আল কুরআন ও ছাহেবে কুরআন)- সুন্নাহ বা হাদীস হলো কুরানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী।












