জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন! এ মহান বিশ্ব সৃষ্টি অনর্থক নয়, পৃথিবীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য আছে। আসমানজমীন, চন্দ্রসূর্য, গ্রহনক্ষত্র, নদনদী, পাহাড়পর্বত সমগ্র সৃষ্টিরাজির সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো বান্দা আল্লাহর ইবাদত তথা দাসত্ব করবে, আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ইবাদত। মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি আহবান করা, একত্ববাদের প্রতি হিদায়ত করার জন্য পৃথিবীতে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য নবীরাসূল আলাইহিমুস সালামকে প্রেরণ করে দ্বীনি আদর্শ প্রচার, দ্বীনি শিক্ষার প্রচার প্রসারের পথ সুগম করেছেন। নবীরাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতায় হযরত লূত (.) ধরাধামে প্রেরিত হয়ে পথভ্রষ্ট জাতিকে সুপথে পরিচালিত করতে আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

হযরত লূত (.)’র পরিচিতি:

হযরত লূত (.) ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ভাতিজা। তিনি ইবরাহীম (.)’র সহোদর হাররানের পুত্র। তিনি খ্রি. পূ. ২১২০ অব্দে তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মভূমি “ফাদ্দান আরাম” নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এক বর্ণনা মতে লূত (.) দক্ষিণ ইরাকের প্রাচীন শহর “উর” নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইবরাহীম (.)’র উপর সর্বপ্রথম লূত (.) ঈমান আনেন। হযরত ইবরাহীম (.) “সারা”সহ লূত (.) কে সাথে নিয়ে ইরাক থেকে সিরিয়া হিজরত করেন। (তাফসীর নূরুল ইরফান, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি মুহাম্মদ ইয়ার খান নাঈমী (রা.) সূরা আনকাবুত, আয়াত: ২৬ সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা)

লূত (.)’র দু’ কন্যার এক কন্যা ছিলেন “শুয়াইব” (.) এর দাদী, অপর এক কন্যা ছিলেন, আইয়ুব (.) এর মাতা। আল্লাহ তা’আলা হযরত লূত (.) কে নবুওয়ত দান করেন। লূত (.) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৫টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল কুরআনে তাঁর নাম ২৭ বার উল্লেখ হয়েছে। কেনআন থেকে অল্প দূরে জর্দান ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী “সাদ্দুম” অঞ্চলের অধিবাসীকে দ্বীনি দাওয়াতের মাধ্যমে হেদায়তের জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁকে প্রেরণ করেন। তাঁর এলাকায় সার্দ্দুম ‘আমূরা’ দুমা ছা’বাহ ও ছাওয়াহ নামে বড় বড় পাঁচটি শহর ছিল, তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় নগরী ছিল “সাদ্দুম” সেখানকার জনসংখ্যা ছিল চার লক্ষ। আল্লাহর নবী লূত (.) এ জনপদের বাসিন্দার হেদায়াতের জন্য এখানে এসে অবস্থান করেন। এখানকার লোকেরা কুৎসিত কুকর্ম সমকামিতা ও অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিল। তিনি সকলকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে সতর্ক করলেন কিন্তু তারা তাঁর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলনা বরং তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগল। মহান আল্লাহ তাঁর নবীর দাওয়াত ও হেদায়াত প্রত্যাখ্যান করার করণে এ অবাধ্য জাতিকে ধ্বংস করে দেন। হযরত লূত (.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে রক্ষা করলেন, অপরাধীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। সমকামিতার অপরাধে এমন কঠিন শাস্তি লূত সম্প্রদায়ের উপর অবতীর্ণ হলো এত বড় শাস্তি অন্য কোন জাতির উপর আসেনি। (তাফসীরে নুরুল ইরফান)

আল কুরআনে লূত (.) এর অবাধ্য জাতির কুকর্মের বর্ণনা:

লূত (.) এর সম্প্রদায় ছিল কুপ্রবৃত্তির অনুসারী অসভ্য জাতি। পাপাচার, অশ্লীল, কুকর্ম, সমকামিতায় লিপ্ত হয়ে তারা নিজেদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, আখেরাতের কথা ভুলে গিয়েছিল। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি লূতকে পাঠালাম যখন তিনি তার কওমকে বললেন, তোমরা তো এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের আগে দুনিয়াবাসীর মধ্যে কেউ করেনি। তোমরা কি পুরুষদের সাথে অশ্লীল কাজ করছ, তোমরা কি রাহাজানি করছ? এবং তোমরা কি নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে গর্হিত কাজ করছ? এর উত্তরে তাঁর কওম শুধু এ কথা বলল যে, আমাদের উপর আল্লাহর আযাব নিয়ে এসো যদি তুমি সত্যবাদী হও। (সূরা. আনকাবুত, আয়াত: ২৮,২৯)

লূত (.) তাঁর জাতিকে সমমামিতার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন:

লূত (.) এর কওমের অসভ্য লোকেরা নৈতিক অবক্ষয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য তাদের মধ্যে ছিলনা। নির্লজ্জ বেলেল্লাপনা, যৌন উন্মাদনা পাপাচারে মাত্রাতিরিক্ত সীমা লঙ্ঘন ও চরিত্রহীনতার কারণে তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি ছিল অবধারিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর লূত তো তাদেরকে আমার পাকড়াও করার ভয় প্রদর্শন করেছিলেন, কিন্তু তারা ভীতি প্রদর্শন সম্বন্ধে ঝগড়া সৃষ্টি করেছিল। তারা লূতের কাছ থেকে তাঁর মেহমানদেরকে নিয়ে যেতে চাইল তখন আমি তাঁদের চোখ নষ্ট করে দিলাম এবং বললাম আস্বাদন কর আমার আযাব এবং আমার সতর্কবানীর স্বাদ। (সূরা, আল কামার, আয়াত: ১৬৩৭)

হযরত লূত (.) এর দুআ:

নবীগণ নিস্পাপ। গুনাহ থেকে পুত: পবিত্র, সকল প্রকার গুনাহ ও গুনাহর অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তা’আলা নবীগণকে রক্ষা করেন। তবুও আল্লাহর সমীপে দুআ করেছেন অন্যান্য মানব জাতির শিক্ষাদানের জন্যই। তিনি দুআ করেছিলেন ‘হে আমার বর! আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে তাদের অপকর্ম থেকে রক্ষা করো। অতঃপর আমি তাকে ও তার পরিবারের সবাইকে রক্ষা করলাম। (সূরা: আশশু’আরা, আয়াত: ১৬৯,১৭০)

বর্ণিত আয়াতে পরিবারবর্গ দ্বারা পরিবারের মুমিন সদস্যদের বুঝানো হয়েছে। এ দুআর মধ্যে লূত (.) এর কাফির স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত নয়। (তাফসীরে নূরুল ইরফান, কৃত: হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) লূত (.)’র স্ত্রীর নাম “ওয়ালিহা” হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জিবরাঈল (.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অবতরণ করে বললেন, লূত (.) এর স্ত্রীর নাম হলো “ওয়ালিহা”। (ইবন কাছীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃ: ১৮১)

তাঁর স্ত্রী ছিল খিয়ানতকারী, পবিত্র কুরআনে লূত (.) এর স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা লূত (.) এর অবাধ্য জাতিকে ধ্বংস করার জন্য মানবাকৃতিতে মেহমানবেশে লূত (.) এর কাছে তিন জন ফেরেস্তা প্রেরণ করেন। লূত (.) তাঁর চরিত্রহীন জাতির কথা চিন্তা করে আগন্তুক সুদর্শন তিন যুবকের নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাঁর বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী আগন্তুক মেহমানদের ব্যাপারে এলাকার লোকজনদের খবর দিল, তারা অসৎ উদ্দেশ্যে ছুটে এলো। এরপরই শুরু হলো ধ্বংসের তান্ডবলীলা, আল্লাহর গজবে এ শহরের বর্তমান ডেড সী বা মৃত সাগর ঐতিহাসিকদের মতে এসব অঞ্চলের ধ্বংশযজ্ঞের খোদায়ী আযাবের বাস্তব নমুনা। ইতোপূর্বে এখানে কোন সমুদ্র ছিলনা। তাঁর জাতির বেহায়া বেলেল্লাপনা ও বিকৃত যৌন উন্মত্ততার চরম পরিণতিতে ধ্বংশের প্রান্ত সীমায় উপনীত হয়েছিল এ অসভ্য জাতি। ভোরে প্রচন্ড ভূমিকম্পে এ অঞ্চলের মাটি উল্টে দেওয়া হলো, ঝড় তুফান ও শীলা বৃষ্টিতে অবাধ্য জাতি খোদায়ী গজবে ধ্বংস হলো, গোটা এলাকা পানি জমে ভূ সাগরে রূপ নিল। কওমে লূত এর বর্ণিত ধ্বংসস্থলটি বর্তমানে “বাহরে মাইয়েত বা বাহরে লূত, মৃত সাগর বা লূত সাগর নামে খ্যাত। এ সাগরে কোনো প্রাণী পড়লে তার মৃত্যু অবধারিত, এর পানি অত্যন্ত লবণাক্ত, লবণাক্ততা প্রতি লিটারে ৩৫ গ্রাম কিন্তু “ডেড সী”তে প্রতি লিটারে ২৪০ গ্রাম লবণ বিদ্যমান, তাই এতে কোনো মাছ ও জলজ প্রাণী বেঁেচ থাকতে পারেনা। লূত (.) এর জাতির বাসস্থল ছিল লূত সাগর জায়গাটি। তাদের অস্বাভাবিক যৌনকর্ম, সমকামিতা, লুটপাটসহ সীমালংঘনের জন্য আল্লাহ তা’আলা জমীনকে উল্টে দিয়ে বজ্রপাত ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাটির গভীরে প্রোথিত করা হয়। লূত সাগরটি ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে দেন। নিশ্চয় এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন।

হাদীসের আলোকে সমকামী লোকেরা অভিশপ্ত:

ইসলামে সমকামিতাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কুকর্মে লিপ্ত ও অভ্যস্ত লোকেরা ঘৃণিত ও অভিশপ্ত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, অভিশপ্ত ঐ ব্যক্তি যে লূতের কওমের মত কুকর্ম করে। (মিশকাত শরীফ, হাদীস: ৩৫৭৫)

আরো এরশাদ হয়েছে, আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হিসেবে ভয় পাই লূত জাতির কুকর্মের। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৫৭৭)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যাদেরকে তোমরা লূতের সম্প্রদায়ের কাজে (সমকামে) লিপ্ত দেখবে তাদের উভয়কেই হত্যা করো। (তিরমিযী, /৫৭)

হে আল্লাহ আমাদেরকে নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ  তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসিনার পক্ষে লড়বেন না পান্না
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক হুসনে কেরাত সম্মেলন