প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহণ করুন, ইসলামী বিধান শিক্ষা ও আদর্শ ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য মন্ডিত স্মারক হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করুন।
আল কুরআনের আলোকে গণনার মাস: হিজরি সন মুসলমানদের প্রাত্যাহিক জীবনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। হিজরি সানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে। হিজরি সন বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অতীব সম্মানিত ও সমাদৃত। মহা গ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে গণনার মাস বারটি তন্মধ্যে চারটি হারাম বা সম্মানিত ইহাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। এর মধ্যে তোমরা জুলুম নিপীড়ন ও অত্যাচার করোনা, আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে আর মনে রেখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)
আমিরুল মুমেনীন হযরত উমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন: হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়ত ঘোষণা হয়। মক্কার প্রতিকুল পরিবেশে (৬১০–৬২২) পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১২ বৎসর আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীজির রিসালতের মর্মবানী ও ইসলামের শাশ্বত আদর্শ প্রচার করেন। কুরাইশদের প্রচন্ড বিরোধীতা জুলুম নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। নবীজি আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ব্যাপক পরিমন্ডলে ইসলাম ধর্মের প্রচার প্রসারের প্রত্যয় নিয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে মক্কা থেকে ইয়াসরিবে হিজরত করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার মদীনায় প্রবেশ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ও মুসলমানদের স্বাতন্ত্র জাতিসত্তা ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মু’মেনীন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবীজির হিজরতের ১৭ বছর পর ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামি হিজরি সন প্রবর্তন করেন। তিনি জাজিরাতুল আরবের বিভিন্ন ভূখন্ডে হিজরি তারিখ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলেন। ইসলামি দিন পঞ্জির সূচক হিসেবে হিজরি সন প্রবর্তনের কারণে তিনি ইসলামের ইতিহাসে এক নব দিগন্তের সূচনা করেন।
হিজরি সন প্রবর্তনের ইতিহাস: প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ সমূহ হাদীস শরীফের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও ইতিহাসের পরিবেশিত তথ্যের অনুসন্ধানে হিজরি সন প্রবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে বসরার গভর্নর ছিলেন হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) গভর্নর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা লাভের জন্য খলীফা উমর (রা.)’র নিকট লিখিত এক পত্রে উল্লেখ করেন হে আমিরুল মু’মেনীন আমাদের কাছে অনেক চিঠিপত্র আসে এক পত্রে রয়েছে শা’বান তা কি বর্তমান বছরের শাবান নাকি অতীত বছরের তা আমরা নির্ণয় করতে পারছিনা এ সমস্যা নিরসনে খলিফা উমর (রা.) একটি সন প্রবর্তনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। একটি ইসলামী সন প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন, তিনি তাঁর পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন, সভায় সাহাবী হযরত সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের বছর থেকে বর্ষ গননার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। হযরত তালহা নবুওয়াতের বছর, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রদত্ত প্রস্তাবে ঐক্যমত্য পোষণ করেন। (সূত্র: ইবনুল আসীর, আল–কামিল ফিততারিখ ১ম খন্ড, পৃ: ৮, আল্লামা বদরুদ্দিন আয়নী, উমদাতুলকারী ১৭শ খন্ড, পৃ: ৬৬)
হিজরি সন, মাস ও দিন সম্পর্কে জ্ঞান রাখা ফরজে কেফায়া। হিজরি সনের বারটি মাস ইসলামে স্বীকৃত। তাহলো মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউসসানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ্ব। (তাফসীর,মা’আলিমুত তানযীল, ২য় খন্ড)
হিজরি সন গণনা চন্দ্র বর্ষের সাথে সম্পর্কিত: পৃথিবীতে সন গণনার দুটি ধারা রয়েছে। একটি সৌরবর্ষ যার সম্পর্ক সূর্যের সাথে দ্বিতীয়টি চন্দ্র বর্ষ যার সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে। দুটি সনের মধ্যে প্রতি চছর ব্যবধান হয় ১০ অথবা ১১ দিনের। সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ দিনে চন্দ্র বর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে। ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সমূহ চন্দ্র তারিখ বা হিজরি তারিখের উপর নির্ভরশীল। ইসলামী বর্ষের প্রথম মাস মহররম’র আশুরা মহররমের ১০ তারিখ। আখেরী চাহার শোম্বা সফর মাসের শেষ বুধবার। ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে শুভাগমনের স্মৃতি বিজড়িত বরকতমন্ডিত দিনে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ বড়পীর হযরত গাউসল আজম দস্তগীর আবদুলকাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহ আলায়হি’র ওফাত দিবস। ২৭ রমজান পবিত্র লায়লাতুৃল কদর, ১ শাওয়াল পবিত্র ঈদুল ফিতর, ৯ যিলক্বদ মহান আরাফাত দিবস, ১০ জিলহজ্ব পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানির দিবস ও হজ্বব্রত পালনের দিন সমূহ। ২৭ রজব পবিত্র মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ১৪ শাবান দিবগত রজনী লায়লাতুল বরাত ভাগ্যরজনী মুক্তির রজনী। অসংখ্য নবী রাসূল সাহাবায়ে কেরাম তাবেঈন, তবে তাবেঈন, মাযহাবের মহান ইমাম গনের জন্ম ও ওফাতের তারিখ ও সন হিজরি সনের সাথে সম্পৃক্ত।
হিজরি সনের নতুন চাঁদ দেখার দু‘আ: ইসলামি বর্ষের প্রথম মাস মহররমের চাঁদ উদয়ের মাধ্যমে ১৪৪৭ হিজরি সনের সূচনা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর মহান সাহাবায়ে কেরাম আকাশে নতুন চাঁদ উদিত হলে দু্আর মাধ্যমে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করে মহান প্রভূর দরবারে নিম্নরূপ দুআ করতেন, হযরত তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,“আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলামি” ওয়াত তাওফিকী, লিমা তুহিব্বু রাব্বানা ও তারদ্বা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ (তিরমিযী ৩/১৫৭)
অর্থ: হে আল্লাহ এই চাঁদের উদয় আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের চাঁদ হোক। আর তুমি যা পছন্দ কর এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও সেই কাজ করার তাওফিক আমাদের দান করো, আমাদেরও তোমার রব আল্লাহ।
হিজরতের তাৎপর্য: হিজরতের পূর্বে ইসলাম শুধু মক্কায় সীমাবদ্ধ ছিল হিজরতের ফলে ইসলামী আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের সুমহান বাণী ও দাওয়াত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আনসার ও মুহাজির সাহাবীদের মধ্যে গভীর ভালবাসা মমত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। হিজরতের মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
মদীনায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য শান্তি সংহতি ও সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে সকল নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ৫৩টি শর্ত সমন্বিত একটি সনদ প্রদান করেন যা মদীনার সনদ নামে পরিচিত এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। মদীনা সনদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদীনার রাষ্ট্রে মহামান্য রাষ্ট্র প্রধানের মর্যাদায় যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করলেন। সনদের শর্ত ভঙ্গ করার অপরাধে তিনি দুষ্টচক্র ইহুদীদেরকে মদীনা মনোওয়ারা থেকে বহিস্কার করলেন।
মদীনা সনদ শুধু সেই যুগেই নয় সর্বকালে সর্বযুগে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করে। এ সনদ শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয় বরং বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় ঘটনা, সভ্যতা ও বিশ্বমানবতার বীজ প্রোথিত হয়েছিল এই মহা সনদের মাধ্যমে। আজকের পৃথিবীর লীগ অব নেশন্স জাতিসংঘ আটলান্টিক সনদ, মানবাধিকারের ঘোষণা, জেনেভা কনভেনশন এর চেয়েও অনেক বেশী কার্যকর অর্থবহ ও সাফল্যের স্মারক তাৎপর্যমন্ডিত মদীনার সনদ। ঐতিহাসিকগণ হিজরতকে ইসলামের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী মহান ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মদীনা কেন্দ্রীক সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁর জীবদ্দশাতেই ৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে বিস্তৃত হয়েছিল। হিজরি নববর্ষের শুভ পদার্পণে একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের প্রত্যয় মহান আল্লাহ সকলকে তাওফিক দান করুন, আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।