জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ মার্চ, ২০২৫ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, রমজানুল মুবারকের বহুমাত্রিক তাৎপর্য অনুধাবন করুন, জেনে রাখুন! কুরআন নাযিলের মহিমান্বিত মাস রমজান। আত্নশুদ্ধির জন্য মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণের মাস রমজান। প্রশিক্ষণ কোর্স সফলভাবে সমাপ্ত করতে মুমিন বান্দাদের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সিলেবাস। রাতদিন অবিরাম এ সিলেবাস অনুশীলন ও বাস্তবায়নে রয়েছে বান্দার জন্য ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা। পাঁচ ওয়াক্ত নামায তো বান্দার জন্য অবধারিত আছেই। এর বাইরে রয়েছে বান্দার জন্য স্পেশাল পরীক্ষা। এ পরীক্ষার সিলেবাসে রয়েছে এশার নামাযের পর বিশ রাকাত তারাবীহ নামায। তারাবীহতে রয়েছে আল কুরআনের তিলাওয়াত। এ প্রশিক্ষণ কোর্সে রয়েছে সেহরী গ্রহণ, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনভর পানাহার, যৌনক্রিয়া ও সর্ব প্রকার অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার কঠিন সাধনা। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার, মাগরীবের নামযের পর প্রকৃত রোজাদার বান্দার বিশ্রামের সুযোগ নেই, মুআজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসে এশার আজান। এশা ও বিশ রাকাত তারাবীহ আদায়ের প্রস্তুতি। মাসব্যাপী এ প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে বান্দাকে তাকওয়ার গুনে গুণান্বিত করা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য।

তারাবীহতে খত্‌মে কুরআন: রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো এ মাসে নাযিল হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআন। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, রমজান মাস যে মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। (সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫)

পবিত্র রমজানুল মুবারকে তাবারীহর নামাজে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাত।

পবিত্র রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জিবরাইল (.) পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত শোনাতেন:

পবিত্র রমজানে তারাবীহতে যেমন কুরআন তিলাওয়াত ইবাদত তেমনি নামাযের বাহিরেও তিলাওয়াত উত্তম ইবাদত হিসেবে গন্য। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল, রমজানে যখন জিবরাইল (.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবাহমান বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: )

তারাবীহ শব্দের অর্থ: আরবি তারাবীহ শব্দটি বহুবচন। এক বচনে তারবীহাতুন। এর অর্থ আরাম করা, বিশ্রাম করা। তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাত আদায়ান্তে কিছুক্ষণ কলেমা দুআ জিকর পড়া হয় এবং বিশ্রাম নেয়া হয়, তাই তারাবীহ নামে নাম করণ হয়েছে। তারাবীহ নামাযের সময় হলো এশার নামাযের ফরজ ও সুন্নাত আদায়ের পর বিতরের পূর্বে তারাবীহ নামায পড়তে হয়। (হাশিয়াতুল হেদায়া, :১৩৪)

হানাফী মাযহাব মতে তারাবীহ নামায পুরুষ ও মহিলা সকলের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তারাবীহ নামায ছেড়ে দেয়া জায়েজ নেই। (দুরুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত: খন্ড: , পৃ: ৪৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র তারাবীহ নামায আদায় : আল্লাহ তা’আলা পবিত্র রমজানের সিয়াম পালন করাকে ফরজ করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীহ নামায সুন্নাত করেছেন। ইসলামের সূচনাকাল থেকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সকল সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুজতাহিদ ইমাম ইমামগন, মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদ, ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতিদের সর্ব সম্মত মতানুসারে বিগত সাড়ে চৌদ্দশত বৎসর কাল থেকে তারাবীহ নামায বিশ রাকাত সুন্নাত আমল হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ বিষয়ে কেউ কখনো দ্বিমত পোষন করেননি সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নামে এ বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে প্রতিষ্ঠিত এ আমলের রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ইবাদত থেকে বিমূখ করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। যেখানে গোটা রমজানটা অধিক পরিমান ইবাদত বন্দেগী যিকর আযকার দুআ কালাম দরুদ সালাম ইত্যাদি পুণ্যময় আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের অবারিত অপূর্ব সুযোগ আল্লাহ দান করেছেন। সেক্ষেত্রে অসংখ্য হাদীস ও মুজতাহিদ ইমামগণের চূড়ান্ত ফায়সালা ও সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে তারাবীহ নামায আট রাকাত বা দশ রাকাত চালু করার জন্য রীতিমত বিতর্ক সৃষ্টি করা ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিধি বিধান নিয়ে তামাশা করার নামান্তর। পবিত্র হাদীস শরীফ ও ইসলামের বরেণ্য মহামনিষী মুজতাহিদ ইমামগণের বর্ণনার আলোকে তারাবীহর নামায সর্ব সম্মতভাবে বিশ রাকাত। এ প্রসঙ্গে নির্ভযোগ্য প্রমাণাদি উপস্থাপনের লক্ষ্যে এ প্রয়াস।

দলিল নং: :

উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নামায পড়ছিলেন, কিছু সংখ্যক সাহাবা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে নামায পড়লেন, দ্বিতীয় রাতেও মুসল্লীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তৃতীয় ও চতুর্থ রাতেও অনেক সাহাবা মসজিদে নববীতে একত্রিত হলেন কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা মুবারক থেকে বের হলেন না, যখন সকাল হল নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে বললেন তোমরা রাতে যা করেছ (অর্থাৎ তারাবীহর প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছ আমি সবই দেখেছি কিন্তু আমি কেবল এ কারণেই বের হইনি যে আল্লাহ তা’আলা তারাবীহ নামাযকে তোমাদের উপর ফরয করে দিবেন। আর এ ঘটনা ছিলো রমজান মাসে। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ১০৭৭)

উপরোক্ত হাদীস শরীফে রাকাত সংখ্যা উল্লেখ করা না থাকলেও নিম্নের একাধিক হাদীস দ্বারা বিশ রাকাত তারাবীহর বিষয়টি বিশুদ্ধমতে প্রমানিত।

দলিল নং: ০২

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতর নামায পড়তেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, খন্ড:, পৃ: ২৮৬)

তারাবীহ নামাযের প্রথম প্রবর্তক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) বর্ণনা করেন, তারাবীহ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এর প্রথম প্রবর্তক রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারাবীহকে হযরত উমর (রা.)’র দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। যেহেতু তিনি সকলকে হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.)’র পিছনে (জামাত সহকারে) আদায়ের জন্য একত্র করেছেন। (কুদামা, আল মুগনি, :১৬৬)

দলিল নং: ০৩

হযরত ইয়াজিদ বিন রোমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র খিলাফতকালে তারাবীহ নামায বিশ রাকাআত এবং বিতর তিন রাকাত পড়তেন। (মুয়াত্তা মালেক, পৃ: ৪০)

হযরত মওলা আলী (রা.)’র মতে তারাবীহ বিশ রাকাআত হওয়ার হিকমত: হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে নির্দেশ করেছেন, রমজানে লোকদেরকে বিশ রাকাত নাময পড়াবে। উপরন্তু বিশরাকাআত হওয়ার হেকমত হলো ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ এর দ্বারা পূর্ণতা পায়। দৈনিক ফরজ নামায ও ওয়াজিব নামায বিতরসহ বিশ রাকাত। সুতরাং তারাবীহ নামাযও বিশ রাকাত হওয়া সঙ্গত যেন পূর্নতার ক্ষেত্রে সমতা বিধান হয়।( বাহারে শরীয়ত, খন্ড:, পৃ: ৫০, আল বাহরুর রাযেক, :৭২)

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল শরীয়তের প্রামাণ্য দলিল: খোলাফায়ে রাশেদীন বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করাটা হাদীসের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত, তাঁদের আমল শরীয়তের দলীল। তাঁদের অনুসরণ করা অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আকড়ে ধরো এবং মাড়ির দাঁত দ্বারা শক্তভাবে আকড়ে ধরো। (তিরমিযী, হাদীস: ২৬৭৬)

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (.) (ওফাত ১০১৪ হি.) বর্ণনা করেন, বিশ রাকাআত তারাবীহর ব্যাখ্যায় সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত। (মিরকাত শরহে মিশকাত, খন্ড: , পৃ: ১৭৫)

ইসলামের প্রতিষ্ঠিত আমলের বিপরীতে অপব্যাখ্যাকারীদের মনগড়া ভিত্তিহীন দাবী সম্পূর্ণরূপে পরিত্যজ্য। মুসলিম উম্মাহকে ইবাদত বিমূখ করতে তাদের নানাবিধ চক্রান্ত ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। এ শ্রেণির লোকদের মাঝে শবে বরাত, দুআ, মুনাজাত, মাযহাবের ইমামগণের প্রতি অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করার প্রবণতা ও ইসলামের অসংখ্য প্রামাণ্য বিষয়কে অস্বীকার করার প্রবণতা ক্রমাগতভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, এদের বিভ্রান্ত থেকে সতর্কতা অবলম্বন সত্যান্বেষীদের জন্য অপরিহার্য।

তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাত অন্তর দুআ পড়া: তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাত অন্তর তারবিহার বৈঠকে কোন দুআ কালাম বা আয়াত শরীফের তিলাওয়াত দরুদ শরীফ পাঠ, জিকর আযকার পাঠ করবে। এ দুআটি পাঠ করবেন “সুবহানা যিলমূলকে ওয়াল মালাকুতি সুবহানা যিল ইজ্জাতি ওয়াল আজমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জবরুতি সুবহানাল মালিকিল হায়্যিলল্লাজি লা ইনামু ওয়ালা ইয়ামুতু সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়াররুহ”। (গুনীয়া, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৫২)

মাসআলা: তারাবীহ বিশ রাকাআত দশ সালামে আদায় করবে। অর্থাৎ প্রত্যেক দু রাকাত পর সালাম ফিরাবে।

মাসআলা: তারাবীহ মধ্যে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। দু’বার খতম করা উত্তম। অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবেনা। (দুরুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৫১)

মাসআলা: তারাবীহ মসজিদে জামাত সহকারে পড়া উত্তম। যদি ঘরে জামাত সহকারে পড়ে তাহলে মসজিদের জামাত পরিত্যাগের গুনাহ হবেনা। তবে মসজিদে পড়লে যে সওয়াব পাওয়া যাবে তা পাবেনা। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৫১)

মাসআলা: এক ব্যক্তি এশার ও বিতর নামায পড়াল অন্যজন তারাবীহ পড়াল এরূপ পড়া জায়েজ। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এশার ও বিতরের ইমামতি করতেন। হযরত উবাই বিন কাব (রা.) তারাবীহর ইমামতি করতেন। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৫৩)

হে আল্লাহ আমাদের রমজানের ফযীলত দান ও বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনন্য গ্রন্থ ‘উল্টো থেকে’
পরবর্তী নিবন্ধচিরকেলে একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষাগুলো যাঁর চিরঅন্বিষ্ট