জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:১১ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা: আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলুন, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায আদায় করুন। জেনে রাখুন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ফরযিয়াত পবিত্র কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত,এর অস্বীকারকারী কাফির। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। (সূরা: বাকারা, :৪৩)

ঈমানের পর নামাযের স্থান: ঈমানের পর নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। নামায দ্বীনের স্তম্ভ, দ্বীনের খুটি। নামায মু’মিন নরনারীর ঈমানের নিদর্শন, নামায জান্নাতের চাবি কাঠি।

নামায মি’রাজের শ্রেষ্ঠ উপহার: নামাযই একমাত্র ইবাদত যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার আদায় করা ফরজ। প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারী সকলের জন্য যা অপরিহার্য। নামাযের অপরিহার্যতা ও ফরযিয়াত প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস এরশাদ হয়েছে হযরত উবাদা ইবন সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেছেন। (বাদায়েউস সানায়ে, ১ম খন্ড, পৃ:৯০)

মিরাজ রজনীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নামায অর্জন ও ফেরত পথে হযরত মুসা (.)’র সাক্ষাৎ: মিরাজ রজনীতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস গমন, মসজিদুল আকসায় নবীজির ইমামতিতে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার আম্বিয়ায়ে কেরামের দু’রাকাত নামায আদায়, মসজিদুল আকসা হতে আসমান সমূহ পরিভ্রমণ, প্রত্যেক আসমানে নবীগণ কর্তৃক প্রিয় রাসূলকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন, নবীদের সাথে সালাম বিনিময়, কথোপকথন, ষষ্ঠ আসমানে দাঁড়িয়ে ইবাদতরত মুসা (.)’র নামায পর্যবেক্ষণ, সপ্তম আসমানে ইবরাহীম (.)’র সাক্ষাৎ অর্জন, সপ্তম আসমানে ফিরিস্তাদের কিবলা বায়তুল মামুর পরিদর্শন, বায়তুল মামুরে প্রবেশ করে নবীজির নামায আদায়ের সৌভাগ্য অর্জন। সপ্ত আকাশ অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহা গমন, সিদরাতুল মুনতাহা দেখার পর জান্নাত পরিদর্শন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সিদরাতুল মুনতাহা পরিদর্শনের। পর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। সেখানে আমি মুক্তা নির্মিত গম্বুজ দেখেছি, আর জান্নাতের মাটি হলো মিশকের। নবীজি জান্নাতের প্রাসাদ সমূহ পরিদর্শন করলেন।

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, আমি স্বর্ণের একটি প্রাসাদ দেখলাম, বললাম এ প্রসাদ কার জন্য? তারা বললেন, কুরাইশের এক যুবকের, আমি মনে করলাম সেজন আমি হব, জিজ্ঞেস করলাম ঐ যুবক কে? তারা বললেন, এটা হযরত উমর ইবন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্য। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৬৮৮)

জান্নাত পরিদর্শনের পর জাহান্নাম আমার সম্মুখে উন্মুক্ত করা হয়। এতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার আযাব গযব এবং প্রতিশোধ। এতে যদি লোহা এবং পাথরও নিক্ষেপ করা হয় তাও ভস্মীভূত হয়ে যাবে। [সীরাতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আল্লামা শিবলী নু’মানী (.)]

তিনি জাহান্নামের প্রহরী মালেককে বললেন, জাহান্নামের প্রথম স্তরের ঢাকনা উন্মুক্ত করো, আমি জাহান্নামী নারী পূরুষদের অবস্থা দেখে নিই, উন্মুক্ত করা হলো, তিনি দেখলেন প্রচন্ড কালো, নিবিড় অন্ধকার তার অন্ধকার সাত জমীনের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত, এর স্ফুলিঙ্গ উৎক্ষিপ্ত আরশে মকীন পর্যন্ত তা দেখে কেঁদে ফেললেন, কারণ জিজ্ঞেস করলে জিবরাঈল (.) বললেন, জাহান্নাম আল্লাহর গযব দ্বারা সৃষ্ট তা আল্লাহর অবাধ্যদের উপর পরাক্রান্ত। তা হাজার বছর গযব দ্বারা তাপ দেওয়া হলো ফলে তা সাদা হয়ে গেল, তারপর তা হাজার বছর গযব দ্বারা তপ্ত হয়ে লাল হয়ে গেল, তারপর তা হাজার বছর তাপ দ্বারা তপ্ত হয়ে কালো আকার ধারণ করল, তার উজ্বলতা দূরীভূত হলো নিবিড় কালো হয়ে গেল এমন তীব্র কালো হয়ে গেল জাহান্নামীরা পরস্পর কেউ কাউকে দেখেনা। এতে স্তর সাতটি। প্রথম স্তর হলো আপনার অবাধ্য উম্মতদের জন্য যারা আপনার শরীয়তের বিরোধীতা করে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দৃষ্টি দিলেন, আগুনের স্ফুলিঙ্গসমূহ প্রত্যক্ষ করলেন, এর বিভিন্ন রহস্য অবগত হলেন, একদল জাহান্নামী দেখলেন যাদের মুখমন্ডল রক্তে পরিপূর্ণ, কঠিন আযাবে লিপ্ত, জিবরাঈল (.) বললেন, এরা আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথকারী এবং পরকালের শাস্তিকে হালকা তুচ্ছজ্ঞানকারী, অপর একদল জাহান্নামীর দিকে দেখলেন তারা আগুন ভক্ষণ করছে ও রক্তপান করছে অনুতাপ ও লজ্জায় নিজের মুখের চামড়া নিজেরা কামড়ায়ে ছিঁেড় ফেলছে, জিবরাঈল (.) বললেন এরা অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ ভক্ষণকারী, অপর একদলের দিকে তাকালেন তাদের মুখ আগুনে ভরপুর, তাদের নাকের ছিদ্র দিয়ে ধুঁয়া বের হচ্ছে, তাদের পায়ে জিঞ্জির, জিবরাঈল (.) বললেন, এরা সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদ ভক্ষণকারী। নবীজি অপর এক দলের প্রতি তাকালেন, লৌহের জিঞ্জিরে তাদেরকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের যৌন পথে পূঁজ বেয়ে পড়ছে, তারা কঠিন আযাবে লিপ্ত। এরা আপনার উম্মতের ব্যাভীচারী। অপর একটি দল দেখলেন বিচ্ছু ও সর্প তাদেরকে দংশন করছে। জিবরাঈল (.) বললেন, এরা মদ্যপায়ী দল। (নূরই মুজাসসাম মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পৃ: ৪২১৪২২)

হযরত মুসা (.)’র পরামর্শে পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে নামায হলো পাঁচ ওয়াক্ত: মহান আল্লাহ মি’রাজ রজনীতে তার প্রিয় হাবীবকে অসংখ্য নি’য়ামত রহমত বহুবিধ পুরস্কার ও অসাধারণ মর্যাদায় সম্মানিত ও ভূষিত করেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা, এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, অত:পর আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হল, আমি ফিরে আসলাম এবং হযরত মুসা (.)’র নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনাকে কিসের নির্দেশ দেয়া হয়েছে? নবীজি বলেন, আমাকে দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, হযরত মুসা (.) বলেন, আপনার উম্মত প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে সক্ষম হবেনা। আল্লাহর শপথ আমি আপনার পূর্বে মানুষদের থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমি বনী ইসরাইলীদের অনেক কঠিন পরীক্ষা করেছি তাদের তুলনায় আপনার উম্মত খুবই দূর্বল। সুতরাং তারা পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে সক্ষম হবেনা। আপনি স্বীয় প্রভূর কাছে গমন করুন, এ আদেশ সহজতর করার আবেদন করুন। আল্লাহ তা’আলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায হ্রাস করে দিলেন, এরপর তিনি মুসা (.)’র নিকট আগমন করলে তিনি আবার অনুরূপ পরামর্শ দিলেন, নবীজি আবার ফিরে গেলেন এভাবে মুসা (.)’র পরামর্শে বারবার ফিরে গিয়ে আবেদন করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায অবশিষ্ট রয়ে গেল। সর্বশেষ নবীজি বলেছিলেন আমি বারবার আবেদন জানাতে লজ্জাবোধ করছি। সর্বশেষ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ হিসেবে রয়ে গেল কিন্তু এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াবে সমান।

মসজিদে আকসা হয়ে মি’রাজে গমনের রহস্য: প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আমাদের প্রিয় নবী মি’রাজের দুলহা, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে গমন না করে যদি সরাসরি আসমান সমূহ পরিভ্রমণ করে সিদরাতুল মুনতাহা আতিক্রম করে লা মকামে গমন করলে নবীজির মি’রাজ হয়ে যেতো, কিন্তু একলক্ষ চব্বিশ হাজার আম্বিয়ায়ে কেরামের মি’রাজ অর্জন হতোনা, কেননা নবীজির মি’রাজ হলো আল্লাহর দিদার লাভ করা, আর অন্যান্য নবীদের মি’রাজ হলো আমাদের নবীর দিদার লাভ করা। (আনোয়ারুল বয়ান ২য় খন্ড)

হযরত আবু বকর (রা.)’র সিদ্দিক উপাধি লাভ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজের সফর শেষ করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন পরদিন সকালে তিনি কুরাইশদের সম্মূখে এ ঘটনা প্রকাশ করলেন, কুরাইশের অধিকাংশ লোকেরা আল্লাহর নামে শপথ করে বললো, এতো এক বিস্ময়কর অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব ব্যাপার। তাদের হিসেব মতে একটি কাফেলা সিরিয়া যাতায়াত করতে যেতে একমাস আসতে একমাস সময় লাগে, আর মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিনা এক রাতের সামান্য সময়ে সেখানে গিয়ে আবার মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন এ ঘটনার বিবরণী শুনে অসংখ্য নওমুসলিম দুর্বল মুসলমানরা ইসলাম ত্যাগ করলো, একদল এ সম্পর্কে হযরত আবু বকর (রা.)’র মতামত জানতে চাইলো এবং তারা বললো হে আবু বকর! মুহাম্মদ দাবী করছেন তিনি নাকি গতরাতে বায়তুল মোকাদ্দাস গিয়েছিল এবং সেখানে নামায আদায় করেছেন এবং রাতেই ফিরে এসেছেন হযরত আবু বকর মি’রাজ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য শুনে তাদের বললেন তোমরা কি তাঁেক মিথ্যাবাদী মনে কর?

তারা বললো অবশ্যই। হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম! তিনি যদি এরূপ বলে থাকেন, তবে তিনি সত্যিই বলেছেন। এতে তোমরা অবাক হচ্ছ কেন? আমি তো এর চেয়েও অনেক কঠিন ও জটিল বিষয়ে তাঁর সত্যতা স্বীকার করি, আল্লাহর কসম তিনি তো আমাকে এ সংবাদও দেন যে দিনরাতের মুহূর্তের মধ্যে তাঁর কাছে আসমান থেকে ওহী আসে আর আমি তা বিশ্বাসও করি, এ ঘটনা কি তার চেয়েও কঠিন। হযরত আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মি’রাজের বর্ণনা শুনে প্রতিবারই বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি সত্যই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল, সেদিনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর (রা.) কে সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করলেন। (সীরাতুন নবী {সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম} (দ্বিতীয় খন্ড, পৃ: ৭৪)

মি’রাজুন্নবী ‘নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিস্ময়কর মু’জিযা ও শ্রেষ্ঠত্বের অভ্রান্ত দলীল। এ পুণ্যময় মাসে নফল নামায আদায় করুন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বমানবতার কল্যাণে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) অবদান
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী অলিম্পিক প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্টে সেরা ইছানগর যুব সংঘ