মুক্তির মহানায়ক বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে ভেবেছিলেম রবি ঠাকুরের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ সঙ্গীতের অবগাহনে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব। কিন্তু করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের ভয়াবহ বিস্তার ও নির্দয় প্রাণ সংহারে ক্ষত–বিক্ষত মানবহৃদয়ের করুণ অনুরণন ও সম্ভাব্য অধিকতর ভয়ানক করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস কঠিন এক হৃদয়বিদারক ও যন্ত্রণাকাতর দৃশ্যপট নির্মাণ করে চলেছে। একদিকে অসহায় মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে দানবরূপী হিংস্র কতিপয় অর্থ–ক্ষমতা–সম্পদলিপ্সু কুৎসিত মানুষের কদর্য মনোবৃত্তির বহি:প্রকাশ প্রকৃত অর্থে অন্তরে এক অজানা আতঙ্ক–আশঙ্কা বাসা বেঁধেছে। এরই মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিন অনেকটা আনন্দবার্তার জয়ধ্বনি করছে।
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা কবি জীবনানন্দ দাশের ‘শঙ্খচীল ’কবিতার পংক্তি উচ্চারণে অভিবাধন জানাতে চাই প্রাণ প্রিয় নেত্রীকে – ‘আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে,/ আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।/ আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে,/ আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে।/ আমাদের দেখা হোক কান্নার ওপারে,/ আমাদের দেখা হোক সুখের শহরে।/ আমাদের দেখা হোক হাতের তালুতে,/ আমাদের দেখা হোক ভোরের আলোতে।/ আমাদের দেখা হোক বিজ্ঞান জিতলে,/ আমাদের দেখা হোক মৃত্যু হেরে গেলে।/ আমাদের দেখা হোক আগের মত করে।/ আমাদের দেখা হোক সুস্থ শহরে…।’ বাঙালিসহ সমগ্র বিশ্ববাসীর অবন্ধ্য মিনতিভরা প্রত্যাশায় উদ্ভাসিত হোক বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিন।
জাতির ভাগ্যাকাশে অতিশয় নৃশংস কালো অধ্যায় ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। সপরিবারে সভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞে শাহাদাত বরণের চৌহদ্দীবিহীন ক্রন্দনের আবাপন এই দিন। বিদেশে অবস্থান করার কারণে বেঁচে গেলেন জাতির জনকের অত্যন্ত আদরের তনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। অনেক নির্যাতন, নিপীড়ন ও বন্দী জীবনকে পরাভূত করে এদেশের মাটি ও মানুষের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্নিগ্ধ শরৎকালে জন্ম নেওয়া বাংলার কাশফুল কন্যাই হচ্ছেন বিশ্বে ধরিত্রী–সমুদ্র–সীমান্ত–মঙ্গা–উন্নয়ন–সততা–মহাকাশ–পরিবেশ বিজয়ী অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সকল সূচকে ঈর্ষণীয় অর্জনের গৌরবগাথায় বিশ্বদরবারে সমাদৃত বিস্ময়কর ও অভাবনীয় অগ্রগতির স্মারক জাতির জনকের ‘হাচু’ এবং তাঁর শহীদ সন্তানদের প্রিয় ‘হাচু আপা’ এবং বাঙালির গভীরতম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নেত্রী আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রাচ্যের আধুনিক উন্নয়ন নায়কের যে নামটি অতি সম্মানের সাথে বিশ্ব পরিমন্ডলে এখনও উচ্চারিত, তিনি হচ্ছেন মালেশিয়ার ড. মাহাথির মুহাম্মদ। ২২ বছরের অত্যন্ত দক্ষ, যোগ্য ও প্রজ্ঞার রাষ্ট্র প্রশাসনের মাধ্যমে যিনি মালেশিয়াকে একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অতি উঁচু মার্গের প্রাচ্যখ্যাত উন্নত দেশে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন ভাষণে যে বার্তাটুকু অত্যন্ত নিপুনভাবে বিশ্ববাসীকে পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তা হল চমৎকার দুটি প্রত্যয় ; ক) ঐড়হবংঃু (সততা) ও খ) ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু (সম্ভাবনা) অর্থাৎ সততার কর্ষণ, চর্চা, বিকাশ ও বিস্তার এবং সচল সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে অপার সম্ভাবনাকে জাতির কল্যাণে নিশ্চিত করা। অতুলনীয় এই ব্যক্তিত্বের প্রাণস্পন্দন ছিল তাঁর দেশের জনগণের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। দৃঢ়চিত্তে পশ্চিমা বিশ্বের সকল লুম্পেন বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে আপন শক্তিতে মহিয়ান হয়ে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে প্রজ্জলিত করেছেন।
ঠিক একই রকম বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনেক ভাষণে যে বিষয়টি দাবী করেছেন – ‘সত্যের জয় অনিবার্য ’ এবং ‘সততার জয়ও অবশ্যই অনিবার্য’ তথা বলিষ্ঠচিত্তে নির্ভীক স্বাধীনস্বত্তায় আত্নপ্রত্যয়ী এ মহিয়সী নেত্রী তথাকথিত উন্নত বিশ্বের শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও অপপ্রচারণা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল অশুভ চক্রান্ত ও প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে ইতিমধ্যে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং পদ্মাসেতু নির্মাণে মিথ্যা নাটকের অবসান ঘটিয়ে ‘আমরাও পারি’ ব্রত গ্রহণ করে পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অবয়বে অবিস্মরণীয় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছেন। কবি সুকান্তের ভাষায় বাঙালির আবেগী এবং অবিনাশী শক্তির শাণীত চেতনায় সমস্বরে নেত্রীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে চাই – ‘সাবাশ বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় – জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
দেশের উন্নয়নের একটি প্রধান খাত জনশক্তি রপ্তানি, যার মাধ্যমে প্রবাসীদের উপার্জিত আয় দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে সমৃদ্ধ এবং আর্থিক বুনিয়াদকে করে শক্তিশালী। অনেক চক্রান্তকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের কমশিক্ষিত/প্রশিক্ষিত ও দক্ষ/অদক্ষ এই মানব সম্পদ বিশ্বের প্রায় শ্রমবাজারে অত্যন্ত পরিশ্রমী যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে দেশের ভাবমূর্তি করেছেন অতিশয় উজ্জ্বল। এই অন্যতম উপার্জন খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থে আজ দেশে রিজার্ভ ফান্ডের পরিমাণ প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য; অভাবী ও হতদরিদ্র্য দেশের এই মানবসম্পদ কি নিদারুণ কষ্টকে পরিহার করে প্রবাসী জীবন যাপনের মাধ্যমে কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে যে অর্থ উপার্জন করছেন তা জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বক্তব্যে উঠে আসে এভাবে – “ঞড়ড় সধহু ড়িৎশবৎং ংঃরষষ হড় িষরাব রহ ঃযব ড়িৎংঃ পড়হফরঃরড়হং যধারহম ষবধংঃ ধপপবংং ঃড় নধংরপ ংবৎারপবং ধহফ ভঁহফধসবহঃধষ ৎরমযঃং ড়ভ ঃযবসংবষাবং; ঃযঁং সধশরহম ঃযবস ফরংঢ়ৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধঃবষু াঁষহবৎধনষব ঃড় বীঃড়ৎঃরড়হং, ারড়ষবহপব, ফরংপৎরসরহধঃরড়হ ধহফ সধৎমরহধষরুধঃরড়হচ.
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিগত কিছুদিন ধরে করোনাকালে দেশে ছুটিতে আসা প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার দেশসমূহ থেকে প্রাপ্ত আকামা ও ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণের বিষয় ও বিমান টিকেটের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধি যারপরনাই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে তিন সপ্তাহের সময় বৃদ্ধি কিছুটা স্বস্তির আবহ তৈরি করলেও এই ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুভ জন্মদিনে অনুরোধটুকু জ্ঞাপন করতে চাই। করোনায় আক্রান্ত না হওয়ার স্বাস্থ্য সনদ সংগ্রহে এবং কর্মরত দেশে ফিরে দুই সপ্তাহের অধিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা সময়কাল ব্যতিরেকে আমাদের এই কর্মযোগ্য বন্ধুরা কর্মে যোগদানের যথাযথ সুযোগটুকু গ্রহণ করতে পারে, তারও বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক জীবন ব্যবস্থার স্বাধীন দেশ উপহার দেওয়ার স্বপ্ন থেকেই দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছিলেন। জাতির কাছে বঙ্গবন্ধুর আবেদনটুকু ছিল ‘আমার গরীব জনগণ যেন মোটা ভাত খেয়ে এবং মোটা কাপড় পরে শান্তিতে থাকতে পারে’। গরীব মেহনতি জনতার নির্মম দরিদ্রতাকে উৎপাটন করে একটি ক্ষুধামুক্ত – দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনিমার্ণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সুদৃঢ় লক্ষ্যস্থির নিশ্চিত করে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। করোনার সঙ্কট উত্তোরণে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায়োগিক পরিকল্পনা নেত্রীর বিচক্ষণতা ও নির্ভীকতাকে নতুন মাত্রিকতায় অত্যুজ্জ্বল করে তুলেছে।
শরতের শিউলি চাদরে আচ্ছাদিত অন্ধকার রাত্রি শেষে আলোকিত সকাল, শস্যপূর্ণ মাঠ, কৃষক–কিষানীর আনন্দের ফসলী গান ইত্যাদির সমন্বয়ে শরতের সাবলীল সত্য–সুন্দর–কল্যাণ–মঙ্গলের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক বার্তায় প্রাণিত বাংলার মানুষ খোঁজে পায় দেশপ্রেমের নতুন ভাবনা এবং চেতনাসমৃদ্ধ উদ্ভাবনের আবর্তন। এই শরতে জন্ম নেয়া সামগ্রিক আলোকোজ্জ্বল নয়নাভিরাম রূপবৈচিত্র্যের অনন্য প্রভাবে দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্ম এক অপরূপ দেশমাতৃকার প্রতি নিরন্তর ভালবাসার প্রতীক। এজন্যই তিনি বিশ্বনন্দিত এবং যুগ পরিবর্তনের অপরূপ আলোকবর্তিকা।
পিতার মতো সুযোগ্য তনয়াও অবিরাম ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সকল অশুভ অন্ধকারের শক্তিকে নিধন করে দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন – নি:সন্দেহে তা বলা যায়। নিঁখাদ দেশপ্রেম, সততাস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় নতুন দিগন্তের সূচনা, মানবিকতা–অসাম্প্রদায়িকতা–সৃজনশীলতা–অগ্রসরমানতার মেলবন্ধনে উড্ডীন হবে করোনা জয়ের নতুন পতাকা এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিরবচ্ছিন্ন প্রস্তুতির পরিকল্পিত চিন্তন। এর সামগ্রিক সমীকরণেই পরিপূর্ণতা পাবে জাতির জনকের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার আরাধ্য স্বপ্ন। শুভ জন্মদিনে মহান স্রষ্টার কাছে এই মহিয়সী নেত্রীর ঝুঁকিমুক্ত–নির্ভয়–নির্ভার নিরাপদ সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করছি। জয় হোক বাংলার–আপামর দেশবাসীর। অজস্র মহিমায় কল্যাণধন্য হউক বাঙালি জাতি–রাষ্ট্র। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু–বঙ্গমাতা, জয়তু শেখ হাসিনা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।