মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট অংশে জুড়ে আছে জীবনী সাহিত্য। জীবনী সাহিত্য ধর্মীয় মহাপুরুষদের জীবনীর পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন,সমাজজীবন ও রূপকথা বিধৃত হয়েছে। জীবনী সাহিত্য ধারায় মহাপুরুষদের জীবনের অদ্যোপান্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পাঠকগণ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার প্রয়াস পান। তাই মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল মূলত ধর্মাশ্রিত। দেবদেবীর কথা, ধর্মকথা প্রচারই এ সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কিছুটা মানবিকতা থাকলেও তা ধর্মের মোড়কে আবৃত। সুতরাং সে–অর্থে মধ্যযুগে মৌলিক সাহিত্য রচিত হয়নি। কেবল সমগ্র মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন অবলম্বন করে রচিত জীবনী সাহিত্য একমাত্র মৌলিক সাহিত্য। তবে আধুনিক যুগে জীবনী সাহিত্য বলতে আমরা যেমন ব্যক্তিত্ববান মানুষের ভাল–মন্দ, দোষ–গুণ,ভুল–ভ্রান্তি,উত্থান–পতন প্রভৃতি বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রত্যাশা করি,মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যে তা প্রত্যাশা করা হবে নিরর্থক। তবে মধ্যযুগের প্রথানির্ভর সাহিত্যের মধ্যে মর্ত্যের মানুষকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্যের মতো একটি সাহিত্যের শাখা গড়ে উঠেছে এখানেই এ সাহিত্যের নতুনত্ব ও গুরুত্ব।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারায় জীবনী সাহিত্য এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈত্যনদেব ও তার কতিপয় শিষ্যের জীবন কাহিনি নিয়ে এ জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। তবে তার মধ্যে চৈতন্য জীবনীই প্রধান। চৈতন্যদেব যে প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন–তাতে মানুষে মানুষে উঁচু– নিচু, হিন্দু–মুসলমান জাত বিভেদ ভুলে সবাই প্রেমমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছে। ফলে তার শিষ্যগণ তার প্রেমধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তার জীবনী নিয়ে আলোচনা করতেন,তা থেকেই এ জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত।
মধ্যযুগের সাহিত্য যেহেতু ধর্মাশ্রয়ী সে–অর্থে চৈতন্য জীবনী সাহিত্য এর প্রভাবমুক্ত নয়। কারণ চৈতন্যকে অনেকেই কৃষ্ণের অবতার হিসাবে বিবেচনা করছিলেন। তাই তার জীবনীকাব্য ভক্তিকাব্য হয়ে পড়েছে। চৈতন্যের ভক্তরা তাকে নবরূপী নারায়ণ হিসাবে বিবেচনা করতেন। তাই তার জীবনচরিতে ভক্তি মিশ্রিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে, জীবনীগ্রন্থ হয়েছে দেব–অবতারের মঙ্গলপাঁচালী। তবে তারা সে যুগের দেশ কাল উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে সে সময়ের সামাজিক, ভৌগোলিক অবস্থা এ সাহিত্য ফুটে উঠেছে। চৈতন্য জীবনকারদের উদ্দেশ্য ছিল গৌড় সমাজে গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে কাহিনিতে অলৌকিকতা এসেছে। তবে জীবনী সাহিত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে, তারা সর্বপ্রথম মর্ত্যের মানুষকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা করেছেন। বাস্তব মানুষ সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। জীবনে সাহিত্য দুভাগে বিভক্ত–সংস্কৃত জীবনী ও বাংলা জীবনী।
চৈতন্যের প্রথম জীবনী রচনা হয় সংস্কৃত ভাষায়। নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস প্রমুখ কবিগণ চৈতন্য বিষয়ক পদ রচনা করেছেন।
চৈতন্যের প্রথম জীবনী লেখক মুরারী গুপ্ত। তিনি চৈতন্য দেবের সমসাময়িক ছিলেন বিধায় অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার কাব্যের নাম শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত।
কবি কর্ণপুর উপাধিধারী পরমানন্দ দাস সংস্কৃতে দু’খানি গ্রন্থ রচনা করেন–শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য।
চৈতন্য দেবের বাংলা জীবনীগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির জীবন, সমাজ ও সাধনা সম্পর্কিত অনেক মৌলিক ঐতিহাসিক তথ্য এসব গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে।
বাংলায় প্রথম চৈতন্য জীবনী লেখক বৃন্দাবন দাস। তিনি তার গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে কাব্যটি লিখেছেন। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্য ভাগবত।
চৈতন্যদেবের জীবনকারদের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্য নানাদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্যচারিতামৃত। আরও অনেক কবিগণ চৈতন্যদেবের জীবন অবলম্বনে জীবনী সাহিত্য রচনা করেছেন।
মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যের ইতিবাচক প্রভাব যেমন সমাজজীবনে পড়েছিল তেমনি সাহিত্যাঙ্গনও সমৃদ্ধ হয়েছিলো। মধ্যযুগের কবিরাই সর্বপ্রথম জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত করেন। বাস্তব মানুষকে অবলম্বন করে তারাই প্রথম জীবনী লেখেন। তার থেকে জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। যার ফলে আধুনিক যুগের সাহিত্যিকগণ জীবনী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং মহৎ মানুষের জীবনী রচনা করে সাহিত্যঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছে।