“জীবনানন্দ আমার কাছে একজন অলীক মানুষ। যে এই মানুষ ছিলো, আমার মনে হয় না। আপনি জীবনানন্দের কবিতা পড়েন, এই লাইনটা যখন পড়ছেন, ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা রাতে’ অথবা, আপনি যখন পড়ছেন ‘কেউ যাহা জানে নাকো, আমি তাহা জানি’ আপনার মনে হচ্ছে না এই পরশুদিন কেউ এটা লিখেছে? অথচ অধিকাংশ মানুষ যা খেয়াল করে না, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দের জন্ম এক বছরে, তাঁরা সমসাময়িক। অথচ জীবনানন্দের কবিতা আমার কেনো মনে হচ্ছে আধুনিক শুধু না, অতি আধুনিক, গতকাল লিখেছেন।
আমাদের প্রিয় ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নাম এসেছে তাঁর কবিতার লাইন থেকে।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি আজও ঘাস খায়–
কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে –’
আমরা শিহরিত হই, কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে!
এখনো বাংলা সাহিত্যে যত রোমান্টিক কবিতা আমরা টানছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আবুল হোসেন পর্যন্ত– বনলতা সেনকে কেউ বিট করতে পারেনি। কেনো পারেনি? আমরা বনলতা সেনের প্রথম লাইনেই সবাই মুগ্ধ হয়ে পড়ি-‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’!
এই আধুনিক লাইনটা জীবনানন্দ লিখলেন কী করে? জীবনানন্দ এজন্য আমার কাছে অসম্ভব একজন অলীক মানুষ।
এখনো পর্যন্ত জীবনানন্দ আমার কাছে ভীষণ কাছের মানুষ তাঁর কবিতার জন্য। আমি তাঁর কবিতা পড়ি, মুগ্ধ হই, আবার পড়ি। কিছু কবিতা অসম্ভব আনন্দে ভাসায়, জীবনকে নিয়ে ভাবায়। যেমন উনি বলেছেন এক জায়গায়–
‘উড়ে গেলে একঝাঁক হরিয়াল পাখি
ভাবি, কতদূর যেতে পারে মানুষ একাকী?
মানুষ একা কতদূর যেতে পারে? কিন্তু জীবনানন্দও তো খুব একা মানুষ। উনি একা মানুষ, একা বাতিঘরের মধ্যে, কত প্রত্যাঘাত খেয়েছেন। তাঁর প্রেম সফল হয়নি, তাঁর স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ভালো না, ছেলেমেয়ে মনমতো মানুষ করতে পারেন নি, কেউ তাঁকে পছন্দ করে না, চাকরির ওপর চাকরি চলে যাচ্ছে।
কিন্তু জীবনানন্দ লেখার ক্ষেত্রে আপোষ করেন নি কখনো–।”
বাংলাদেশের অন্যতম একজন পরিব্রাজক তারেক অণুর চোখে জীবনানন্দ ছিলেন ঠিক এমনটাই। তিনি জীবনানন্দকে নিয়ে তাঁর একান্ত ভাবনা প্রকাশ করেছেন এভাবে। একজন কবি অথবা সাহিত্যিক বিশিষ্টজনের কাছে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা বিবেচনায় আনি সবার আগে।
তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সর্বসাধারণের কাছে যিনি সহজ, যিনি সব পরিস্থিতিতে আশ্রয় হয়ে কাজ করে, যার চিন্তা চেতনা সবাইকে ছুঁয়ে যায় তিনিই প্রকৃত সাহিত্যিক।
এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যদিও সবার আগে, কিন্তু জীবনানন্দও খুব পিছিয়ে নেই। জীবনানন্দ এক জীবনে তেমন করে সুখের ছোঁয়া পাননি। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ, বিমর্ষ, ক্লান্ত। তাই হয়তোবা তাঁর একান্ত ভাবনাটুকুকে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর কাব্যে। তিনি সাহিত্যে তুলে আনলেন তাঁর জীবনের অমোঘ সেসব সত্য, যা তিনি হয়তোবা কারোর সাথে ভাগ করতে পারেন নি। হয়তো জীবনকে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে নিতে গিয়ে তিনি হেমন্তকে আবিষ্কার করলেন। হেমন্তের সমস্তটুকুকে নিজের জীবনের সাথে একাত্ম করে তাকে সাহিত্যে নিয়ে এলেন। তৈরী করলেন অসাধারণ কিছু কবিতা। বলা বাহুল্য, জীবনানন্দের আগে হেমন্তের এত রূপ পাঠকসমাজ আর কারোর কাব্যে দেখার সুযোগ পায়নি।
তাঁর সমস্ত সাহিত্যে তথা কবিতায় হেমন্ত, কুয়াশা, শিশির, ঘাস, লতা, পাতা, নক্ষত্র, তারা, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের বর্ণনা উঠে এসেছে অবলীলায়। তিনি রূপক অর্থে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান তুলে এনেছেন সযত্নে। মানবজীবনের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, হাসি, কান্না যেনো এক লহমায় তাঁর সৃষ্টিকে প্রাণবন্ত করে তোলে প্রকৃতির রূপক উপমায়।
তিনি যখন বলেছেন, আকাশলীনা কবিতায়,
‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’
কী ভীষণ আকুতি প্রিয়তমাকে ফিরে পেতে,
একটিবার!
আবার একই কবিতায় তাঁর ক্ষোভ–
‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’
‘হায় চিল’ কবিতায় বলেছেন–
‘আবার তাহারে কেন ডেকে আন? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’
কেমন হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রতিনিয়ত, তা তাঁর কবিতাতেই প্রকট হয়ে ওঠে।
বাংলা সাহিত্যের এ যাবতকালের লেখা সবচেয়ে রোমান্টিক কবিতা তিনি লিখে গেলেন, যার অনন্য অসাধারণ বর্ণনা আজও পাঠকের অন্তর স্পর্শ করে প্রতিনিয়ত।
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে–নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি–দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
কী অপার্থিব শান্তি খুঁজে পেলেন কবি।
আবার শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজেছেন একইভাবে —-
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ–জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
আবার হয়তো মৃত্যুর চেয়ে মহীয়ান ভাবতে পারেন নি কোনো কিছুকেই।
তাঁর প্রতিপলে আত্মহননের চেয়ে শ্রেয়তর মনে করলেন একবারের জাগতিক মৃত্যুকে।
তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মহীয়ান সেই মৃত্যুর দিকে।
তাঁর কবিতায় আছে–
‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ; ’
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গতা, আধুনিকতার বিচিত্রতা ও হাহাকার, জীবনের দারিদ্রতা, ব্যর্থতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এক অন্যধারার অতুলনীয় কবি ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন।
এতে করে রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে গিয়ে তিনি এক স্বতন্ত্র কাব্য ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। তাতে তিনি একা একজন।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, প্রশংসা, প্রচার, প্রসারের বিশ্রী প্রতিযোগিতায় নিজেকে যুক্ত না করে তিনি শুধু সৃষ্টি করে গেলেন। আর তাতে করে সমৃদ্ধ হয়েছে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য। বাংলা কবিতার ধারায় যুক্ত হলো নতুন পালক। কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁকে, ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। জীবন ও জগতের গভীরতম সত্যকে প্রকৃতির নানা রূপকল্পে তুলে ধরার এই কাব্য বৈশিষ্ট্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্ররূপময়’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, প্রকৃতি, জীবনকে তাঁর কাব্যে মূর্ত করে তুলেছেন। তাই তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবেও অভিহিত হন।
অন্যদিকে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পরই নীহাররঞ্জন রায় তাঁকে ‘মহত্তম কবি’ অভিধা দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরবর্তী জীবনানন্দ দাশই সারা পৃথিবীর যে কোনো স্থানের বাঙালিকে অধিকার করে আছেন।
ট্রামের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করা বাংলাসাহিত্যের এই কবির মৃত্যুর পর তাঁর বিভিন্ন অপ্রকাশিত কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। সবদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম, যশ, খ্যাতি। বেঁচে থাকতে চরম অবহেলা, নিগ্রহ, অপমান কুড়িয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎদের মধ্যে সবার আগে উঠে আসে তাঁর নাম। মৃত্যুর পর জীবনানন্দ যেনো আরও বেশি নতুন, আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এতটুকুও পুরনো হননি তিনি। তাঁর কবিতা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে আজও। শুধুমাত্র কবিতা নয়, তিনি বিচরণ করেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটোগল্প, ইংরেজি প্রবন্ধ প্রভৃতিতে। তবে আজও তিনি ব্যতিক্রমী এক স্রষ্টা হয়ে আছেন বাংলা কাব্যধারায়। তিনি কবিতাতেই মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখা মেলেছেন। শুধু কবিতার জন্যই মহাত্মা হয়ে আছেন ‘মহাত্মাজি’র এই স্রষ্টা।
লেখক: প্রাবন্ধিক।