ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে সুন্দর নিবিড় সম্পর্ক থাকাটা খুবই প্রয়োজন। আবহমান কাল থেকে ছাত্র শিক্ষকের মাঝে এমন মধুর সম্পর্ক ইতিহাস বিধৃত। ছাত্ররা তার শিক্ষকদের পিতা–মাতার মতো সম্মান করবে এবং শিক্ষকরা ছাত্রদের সন্তানের মতো দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। ছাত্রদেরকে বিনয়ের সাথে ভদ্র ও নম্রভাবে শিক্ষকদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। মূলত শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক সমন্বয়হীনতায় নয় বরং অভিন্ন সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর অতীত সুম্পর্কের গৌরব বর্তমান সময়ে সম্মান, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। শাস্ত্রবচনে বলা আছে ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ:’ অর্থাৎ অধ্যায়ন করা বা লেখাপড়া করাই হচ্ছে ছাত্র জীবনের প্রধান কর্তব্য। অন্যথায় শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গঠনের কারিগর। একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তাঁর অনুসারীদের জ্ঞান ও নীতিজ্ঞান শিক্ষা দিতে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও আদর্শ নিয়ে নিম্নে কিছুতা আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীর মন জয় করার জন্য একজন শিক্ষককে অনেক ব্যতিক্রমী কৌশল অবলম্বন করতে হবে যা সমাজের অন্য কোনো শ্রেণীর লোকদের থাকেনা। একজন আদর্শ শিক্ষককে অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে উপদেশ দিয়ে অভিনব কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষণীয় পদ্ধতিতে, প্রয়োজনে গল্পের সাহায্যে পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের মনজয় করা যায়। ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন ‘যদি কোনো দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে যারা পরিবর্তন আনতে পারে। তারা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক’। আমেরিকার প্রেরণা মূলক লেখক আর্থার ওয়ার্ড বলেছেন ‘মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান, মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন’।
পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদা ও সম্মানের পেশা হলো শিক্ষকতা। কাজেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশার লোকের বৈশিষ্ট্যগুলো রুচিসম্মত, নৈতিকতাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে হওয়া প্রয়োজন। একজন ভালো শিক্ষককে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে, তাঁর পোশাকে আশাকে মার্জিত ও শালীনতাসম্পন্ন হতে হবে, নিয়ম নীতির ক্ষেত্রে তাঁকে কঠোর হতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁকে থাকতে হবে তৎপর। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে। শিক্ষককে স্নেহ, মমতার সেতুবন্ধনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি সমতা ও সমদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানলাভের উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। না বোঝা পর্যন্ত একটা বিষয় শিক্ষার্থীদেরকে বারবার পড়াতে হবে। অনুসন্ধিৎসু প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। ধমক দিয়ে প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীদের মনে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক পিতা পুত্রের সম্পর্কের মতো হওয়া প্রয়োজন। পিতামাতা যেমন সন্তানের মঙ্গল কামনায় উদগ্রীব থাকেন তেমনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সাথে শিক্ষাদানে ব্রতী হতে হবে। একজন শিক্ষককে অবশ্যই চৌকস, ধৈর্যশীল এবং ভদ্র গুণাবলির অধিকারী হতে হবে। একজন শিক্ষক নিজেকে যতবেশি চৌকস প্রমাণ করতে পারবেন শিক্ষার্থীসহ সর্ব মহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, আত্মসম্মান ও মর্যাদা ততোধিক বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণে একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হলে শিক্ষককে সর্বাগ্রে সে বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। একজন ভালো শিক্ষক প্রশ্নাতীত ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই পছন্দের ব্যক্তি। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তথ্যভান্ডার বাংলা কোষের প্রতিষ্ঠাতা রেদোয়ান মাসুদ বলেন ‘বাবা–মা আমাদের প্রথম শিক্ষক কিন্তু আসল শিক্ষক হলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক যারা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন’। ভারতের প্রাক্তন দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি সর্ব পল্লী রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন ‘সত্যিকার শিক্ষক তারাই যারা আমাদের ভাবতে সাহায্য করেন’। বিশ্বখ্যাত জার্মান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন ‘সৃষ্টিশীল প্রকাশ এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত করা শিক্ষকের প্রধান শিল্প’। কাজেই একজন প্রকৃত শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে কঠিনকে সহজ করা, দেখা জগৎ থেকে অদেখা জগতে প্রবেশ করতে এবং জ্ঞান আহরণ ক্ষেত্র থেকে জ্ঞান রাজ্যের উর্বর ক্ষেত্রে প্রবেশের সোপান তৈরী করে দেন। স্নেহ, শাসন, মমতা দিয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী জন ডিইউ এর মতে, ‘একজন শিক্ষক হলেন চালক বা পথ প্রদর্শক। তিনি গাড়ি চালিয়ে যাবেন, যে গাড়িতে চালিকাশক্তির উৎস হলো শিক্ষার্থীরা’। কাজেই ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক সুনিবিড়, সুদৃঢ় ও প্রাণোচ্ছল হওয়া প্রয়োজন যেখানে শিক্ষক পাবেন শিক্ষা দানে সন্তুষ্টি এবং শিক্ষার্থীরা পাবেন আনুগত্য ও শ্রদ্ধার আলোকে সত্যিকার জ্ঞান অন্বেষনের পরিপূর্ণ অভয়াশ্রম। শিক্ষার্থীর ধারণ ক্ষমতার পরিধি না ভেবে শিক্ষকদের রোবোটিক পাঠদান মোটেই কাম্য নয়। শিক্ষার্থীর মনের অবস্থা বুঝেই শিক্ষককে পাঠদানে ব্রতী হতে হবে। ইদানীং অনেক শিক্ষক শ্রেণী কক্ষে পাঠদানের চেয়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রাইভেট টিউশন‘ এর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রাইভেট টিউশনির তালিকায় নাম না লেখালে কিছু কিছু শিক্ষক নাকি শিক্ষার্থীর সাথে বৈরী আচরণ করে থাকেন। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্ৎসনা করে তাদের মনোবল ভেঙে দেন কিংবা পরীক্ষার উত্তর পত্রে নাম্বার কম দেন। এমতাবস্থায় শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসার নিরিখে ছাত্র শিক্ষকের মাঝে সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্ক তৈরী হতে পারে না।
নাম প্রকাশ না করে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরলাম। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রাইভেট টিউশনে আমি বরাবরই অনাগ্রহী ছিলাম। তারপরও যুগের প্রয়োজনে নিজের সন্তানদের প্রাইভেট পড়া থেকে বিরত রাখতে পারিনি। আজ থেকে বছর বিশ আগে আমার ছোট ছেলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারি স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে বিজ্ঞান বিষয়গুলো পড়তে যেত। শিক্ষক নাকি ছাত্রদের কোনো একটা কাজ করতে দিয়ে বাথরুমে যেতেন। তারপর পোশাক পরিধান করে তাড়াহুড়ো করে স্কুলের পথে ছুটতেন। মূলত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা সে পাঠদান থেকে কিছু শিখে আসতে পারতো না। আমার সন্তান ১ মাস ৪ দিন পড়ার পর বিষয়টি আমার গোচরীভূত হলে উক্ত শিক্ষককে ১ মাসের বেতন পরিশোধ করে অন্য এক স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষককে দিয়ে বাসায় পড়ানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমার সন্তান স্কুলে গিয়ে সে শিক্ষকের হাতে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় বারবার। আমার সন্তান সে শিক্ষকের কাছে না পড়ে কেন অন্য শিক্ষকের কাছে পড়ে। আমার পরিচয় দিলে লজ্জা পাবে ভেবে আমার সহধর্মিণীকে স্কুলে পাঠাই সন্তানের ৪ দিনের জন্য ১ মাসের বেতন পরিশোধ করতে, পাছে আরো নির্যাতনের শংকা থাকতে পারে। আমার সহধর্মিণীকে মিথ্যা বলে আসতে হয় যে, আমার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চুয়েটে পড়া আমার বড় ছেলেকে তার ছোট ভাইকে পড়াতে হয়। এতকিছু বলার পরেও শিক্ষক একটি ৫০০ টাকার নোট স্বাচ্ছন্দ্যে পকেটে ভরে নিয়েছিলেন। কিন্তু হীন মানসিকতার ঘূর্ণবর্তে আবর্তিত কিছু কিছু শিক্ষক মহান শিক্ষকতার আদর্শকে মাথায় না রেখে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে অনাগ্রহী দেখা যায়। পেশায় শিক্ষক বড় একটি শিক্ষাকার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা নিজ পুত্রের ফলাফল পরিবর্তন করে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমন অপকর্মের জন্য কর্মকর্তাটি সমগ্র জাতির কাছে অপরাধী ও ঘৃণিত ব্যাক্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পক্ষান্তরে যে সন্তানের ভাগ্যোন্ননের জন্য পিতা এমন গর্হিত কাজটি করেছিল, সে সন্তানও একদিন পিতাকে অপরাধী হিসাবে দায়ী করবে। দু’টো বিষয় লিখলাম শিক্ষকের সম্মান খাটো করতে নয় বা শিক্ষক সম্পর্কে অন্যান্যদের শ্রদ্ধাবোধ না জানিয়ে ঔদ্ধত উষ্মা প্রকাশ করতে নয়। বরং সতর্কতার সঙ্গে আন্তরিক হয়ে উদার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষকরা যাতে নৈতিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে মনোনিবেশ করেন এবং শিক্ষার্থীরাও যাতে পিতৃ–মাতৃ জ্ঞানে ভক্তি চিত্তে শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে জীবনকে আলোকিত করতে পারে। কাজেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরীতে জরুরী বিষয়টি হলো শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের প্রকৃত শিক্ষক সুলভ আচরণ। বাদশাহ আলমগীরের উদার পরামর্শ শুনে শিক্ষক বলে উঠেছিলেন “আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির / সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর“। আসলে বাস্তব জীবনে শিক্ষাগুরুর শির উন্নত হওয়া প্রয়োজন শিক্ষার স্বার্থে– শিক্ষার্থীদের স্বার্থে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। শিক্ষকরা শিক্ষা কিংবা গবেষণা কর্ম সম্পাদনের চেয়ে সমসাময়িক অন্যান্য বিষয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে। তেমনি শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্জন থেকে দূরে সরে পরে বিধায় ভালো ফলাফল লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানলাভের পাশাপাশি নীতিনৈতিকতা জ্ঞানলাভে ব্যর্থ হয়।
আবেগ তাড়িত হয়ে কারোর প্রশ্রয়ে আশ্রয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের ওপর অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষকদেরকে নিগৃহীত ও অপমানিত করে থাকে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এটি শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা নয়, গোটা সমাজের জন্য এক চরম অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষকদের মর্যাদা এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণ চিন্তা করে, শিক্ষাককতার আদর্শের কথা ভেবে, সমাজ ও জাতির মঙ্গল ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষককে শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। শিক্ষা যেমন জীবনব্যাপী, তেমনি শিক্ষকও জীবনব্যাপী হয়ে থাকতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর, বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ, ঢাকা।