রেল স্টেশনের ঝামেলা চুকিয়ে যখন রাজপথের ধারে এসে দাঁড়ালাম, তখন পড়ন্ত বিকেল। বাইশ বছর পর আজ নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরলাম। বাবার উপর অভিমান করে সেই যে গ্রীষ্মের গরম সন্ধ্যায় গ্রাম ত্যাগ করেছি, আর ফিরে এসেছি আজ। এই দীর্ঘ দিন যে গ্রামের সাথে, পরিবারের মানুষদের সাথে সম্পর্ক ছিল না, তা একেবারে ভুল। মোবাইলে মাঝে মাঝে ছোট চাচা, আলো ফুপু, ইব্রাহিম মামা, বড় আপার সাথে কথা হলেও ফেসবুকের এই যুগে বলা যায় পুরো পাড়ার মানুষদের সাথে নিত্য যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে।
আমি এখন হাসানপুর সর্দার বাড়ি যাবো। আমার সোনার গ্রাম। আহা গ্রাম! বটতলী, কালী বাড়ির মন্দির, রাণী দিঘি, প্রাইমারি স্কুল, তালবাগান, সব যেনো চোখের সামনে ভাসছে। দীর্ঘদিন পর গ্রামকে দেখবো, ভাবতেই বুকটা হু হু করে উঠলো।
একজন রিকশাওয়ালা হাত ইশারায় ডাকলাম। সে আসলো। ক্লান্ত গলায় বললাম-‘হাসানপুর যাবেন?’ দাড়িওয়ালা রিকশাওয়ালা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ–না কিছুই বলছে না। আবার বললাম-‘যাবেন?’ ক্ষীণ সুরে বলল-‘যাবো, উঠেন।’ আমি রিকশায় চেপে বসলাম।
আধো ভাঙা পথ বেয়ে রিকশা চলছে হাসানপুর। আমার গ্রামের বাড়ি। জালালকে বড্ড মনে পড়ছে। জালাল আমার বন্ধু ছিলো। কেমন আছে সে, অভাবের দিন কী তাদের শেষ হয়েছে! নাকি এখনো দিনে এনে দিনে খায়!
জালালের সাথে দারুণ সখ্যতা ছিলো আমার। ক্লাসে আমরা একই বেঞ্চের পাশাপাশি বসতাম। নবম শ্রেণীর সময় একদিন জালাল আমার কাছে একশত টাকা ধার চাইলো। হাতে কোনো টাকা না থাকার পরও জালালকে টাকাটা দেবো বলে আশ্বস্ত করলাম। জালাল বেজায় খুশি।
কিন্তু আমি টাকাটা পাবো কোথায়! উপায় না পেয়ে বাবার পকেট থেকে একশত টাকা মেরে দিলাম। টাকাটা পেয়ে জালাল আনন্দে কেঁদে দিলো। ওদের ঘরে নাকি তিনদিন ধরে চাল নেই।
পড়ালেখায় মন ছিল না বলে সেবার বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করলাম। বিকেলে রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরতেই বাবা গরু পিটুনি দিয়ে বললেন-‘বের হ আমার বাড়ি থেকে।’ ভারি রাগ হলো আমার। থাকবো না আর এই বাড়ি। মায়ের টাকা জমানো মাটির ব্যাংকটা সুকৌশলে ভেঙে আটশত টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ত্যাগ করলাম। ট্রেনে চেপে বসার আগে গেলাম জালালের কাছে। তার কাছে আমি একশত টাকা পাবো। ধার দেয়া টাকাগুলি ফেরত চাইতে আপত্তি জানালো জালাল। তার হাতে কোনো টাকা নেই। কিন্তু আমি তার আপত্তি কর্ণপাত না করে টাকাটা বার বার ফেরত চাইতেই টেনে আমার গালে কষে এক চড় বসালো জালাল। যা আমার অপ্রত্যাশিত। উপকারের নাম চড়– জালাল এ–কথা আবার প্রমাণ করলো।
তারপর চলে এলাম শহরে। নিঃসন্তান খান সাহেব আমাকে আশ্রয় দিলেন। মৃত্যুর আগে তার সমস্ত বিষয়–সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিলেন। তার অঢেল সম্পদের মালিক হলাম আমি। মাঝে মাঝে গ্রামের কথা, মায়ের কথা, সবার কথা ভেবে যখন এক গভীর বেদনায় গুমরে মরতাম, সে বেদনা মুছে দিতে জীবনে এলো স্বপ্না। বিয়ে করলাম আমরা। একদিন মগবাজারে আচমকা দেখা হলো আমার গ্রামের হেলালের সাথে। তার কাছ থেকে ছোট চাচার নাম্বার সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে গ্রামের খবর নিতাম। ততদিনে বড় আপা, আলো ফুপু, ইব্রাহিম মামাদের নাম্বারও পেয়ে যাই ছোট চাচার মারফত। তারপর আজকের ফেসবুকে পেয়েছি অনেককে।
সর্দার বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করতে রিকশাওয়ালাকে একশত টাকা দিতেই সে আপত্তির সুরে জানালো ভাড়া লাগবে না। আমি অবাক। ভাড়া লাগবে না মানে কী! দ্বিতীয়বার ভাড়া নিতে তাগিদ দিতেই সে বলল-‘আপনি আমার কাছে একশত টাকা পাবেন।’ আমার বুক ধক করে উঠলো। বললাম– ‘কে জালাল?’ দাড়িওয়ালা রিকশাচালক আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, ও তো জালালই। আবার প্রশ্ন করি-‘তুমি জালাল না?’ কাঁপা গলায় বলল-‘আমি জালাল। একসময় আপনার বন্ধু ছিলাম। পাওনা টাকা ফেরত চাওয়াতে আপনাকে সেদিন যে চড় মেরেছি, তার জন্যে আজও আমি অনুতাপে জ্বলি।’ চোখ ভিজে গেলো জালালের। এ কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি! জালালকে জড়িয়ে ধরতেই খেয়াল করলাম আমার দুনিয়া ভেঙে কান্না আসছে। নিয়তি আজ আমার বন্ধুর রিকশায় করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। জালাল চিকন সুরে কাঁদছে। আমি কাঁদছি। একদিন আমরা বন্ধু ছিলাম।