জামাল নজরুল ইসলাম জাতীয় কনফারেন্স : তরুণ গবেষকদের নতুন প্ল্যাটফর্ম

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | রবিবার , ২৯ মে, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

কল্পনা ও উদ্ভাবনের পথে আগামী প্রজন্ম-এ উদ্দেশ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২১ মে বসেছিল তরুণ গবেষকদের মিলনমেলা। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র ও চবি গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা সমিতির যৌথ আয়োজনে এ জাতীয় কনফারেন্সটি যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সেটি পুরোপুরি সফল হয়েছে- এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আমি সত্যিই অভিভূত সারাদেশ হতে আগত তরুণ গবেষকদের এ অভূতপূর্ব সাড়া দেখে। সত্যি বলতে তরুণ গবেষকরা একটি প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেল তাদের আত্মবিশ্বাসকে উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার, যা এতদিন অনুপস্থিত ছিল আমাদের দেশে। তরুণ গবেষকদের নিজেদের ভাবনা, গবেষণার উপাত্ত এবং চিন্তাগুলো পরস্পর বিনিময়ের জন্য এমন বড় আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবীদার ।
সম্মেলনটি সারা দেশের তরুণদের মধ্যে যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল তার প্রমান হলো, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের মোট ৫২৪ জন গবেষক অংশগ্রহণ করেছিল। মোট ৯০০টি গবেষণা পত্র থেকে বাছাইয়ের পর ৪২০টি গবেষণা পত্র চূড়ান্ত করা হয়। এঙেপ্টেন্সের হার শতকরা অর্ধেকেরও কম । চিন্তা করা যায় ? অনেক কনফারেন্সে আয়োজকরা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভালো পেপারের জন্য পেপার জমা দেওয়ার সময় বর্ধিত করে থাকেন। এখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অনেক গবেষণাপত্র জমা হয় । এটা কিন্তু মোটেও সহজ না। গবেষণার ছয়টি বিভাগে আটেরো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল তাদের ভালো প্রেজেন্টেশান ও গবেষণার জন্য।
থাইল্যান্ডে ১৯৭১ সাল থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি ভিত্তিক উদ্ভাবন (এসটিটি) নামক একটি জাতীয় কনফারেন্স প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ঐ দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এতে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। একেকবার দেশের একেক প্রান্তের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিবছর মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে করা শিক্ষার্থীদের গবেষণাগুলোকে একত্রিত করা। ২০১০ থেকে পর পর দু’বছর আমার উক্ত কনফারেন্সে যোগদানের সুযোগ হয় পিএইচডি গবেষক হিসেবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব বিষয়গুলোকে কয়েকটি শাখায় ভাগ করে প্রতিবছর দু’দিনব্যাপী এই কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে ভালো লাগতো, অনুষ্ঠানের কি-নোট স্পিকার থাকতো একজন পদার্থ, রসায়ন বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী। সারাদেশের বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর প্রথিতযশা শিক্ষকরাও আমন্ত্রিত হতেন বক্তা হিসেবে। থাইল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আগত শিক্ষার্থীরা তাদের দেখে উৎসাহিত হতেন এবং মতবিনিময় করতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে এটিকে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে রূপ দেয়া হয়েছে ।
জামাল নজরুল ইসলাম জাতীয় কনফারেন্সটি আমার কাছে তরুণ গবেষকদের জন্য এরকমই একটি প্ল্যাটফর্ম মনে হয়েছে। যেখানে নতুন গবেষকরা নির্দ্বিধায় তাদের কাজ উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। কনফারেন্সে ভৌতবিজ্ঞান ও প্রকৌশল; জীববিজ্ঞান; পরিবেশ বিজ্ঞান কৃষি ও উদ্ভিদ; স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিদ্যা; সমাজ বিজ্ঞান ও মানববিদ্যা; বাণিজ্য এই ছয়টি শাখায় ওরাল প্রেজেনটেশন, পোস্টার প্রেজেনটেশন এবং থ্রি মিনিটস থিসিস বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও সম্মেলন উপলক্ষে অপরাহ্নে মিট ইউথ দ্য আইকন্স, জামাল নজরুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতা ছিল । আমার সুযোগ হয়েছিল ‘ভৌতবিজ্ঞান ও প্রকৌশল’ শাখায় ওরাল প্রেজেন্টেশনের বিচারক প্যানেলের একজন হিসেবে উপস্থিত থাকার। অসম্ভব ভালো লেগেছে তরুণদের প্রেজেন্টেশান ও গবেষণা দেখে। আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম ওরাল প্রেজেন্ট করা একটি গবেষণাপত্র পেটেন্ট এর জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করা হয়েছে। তরুণদের আইকন হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান ও কোভিড সময়ের আলোচিত তরুণ বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা, ‘স্পটলাইট স্পিকার’ হিসেবে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত এবং ‘সম্মানিত অতিথি’ ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম। স্মারক বক্তৃতা করেন তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আরশাদ মোমেন। আরশাদ মোমেন স্যার আমাদের জাজমেন্ট সেশনে চেয়ার ছিলেন। স্যারকে বললাম, জামাল স্যারের নামে কনফারেন্সে গণিতের কোনো পেপার দেখতে পেলাম না। তিনি আফসোস করলেন দেশে গণিত গবেষণার ধরণ নিয়ে এবং বললেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. সুব্রত মজুমদার এর পর দেশে ভালো কোনো বিশুদ্ধ গণিতের গবেষক নেই। এ সেক্টরে তরুণ গণিতবিদদের এগিয়ে আসতে হবে ও গণিত গবেষণায় ফান্ড বরাদ্দ দিতে হবে। সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি তরুণ গবেষক দেখা গেল পোস্টার প্রেজেন্টেশন পর্বে। পাবলিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এশিয়ান উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেশ কয়েকজন ছাত্রীর প্রেজেন্টেশন দেখলাম। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ভুটানের গবেষকদের দেখে, আমার নিজের থাইল্যান্ডের সময়কার কথা মনে পড়ে গেল। তাঁদের বিএসসি লেভেলের গবেষণালব্ধ ফলাফল এ ধরনের একটি কনফারেন্সে উপস্থাপন করতে পেরে তারা অত্যন্ত আনন্দিত। তাদের মতে তরুণদের গবেষণায় উৎসাহিত করতে এ ধরনের প্লাটফর্ম এর অবদান অনস্বীকার্য। সারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের এত তরুণ গবেষক বাংলাদেশের আর কোনো সম্মেলনে দেখিনি। এ সেশনে তরুণদের আত্মবিশ্বাসী উজ্জ্বল মুখ দেখে অসম্ভব ভালো লেগেছে। আয়োজনের আরেকটি মজার আকর্ষণ ছিল স্বনামধন্য জেনেটিক গবেষক ড. আদনান মান্নানের সাবলীল উপস্থাপনায় উন্নত বিশ্বের আদলে তিন মিনিটে গবেষণা কর্ম উপস্থাপন ‘থ্রি মিনিট থিসিস’। নির্দ্বিধায় বলা যায় জামাল স্যার নিজের চোখে এ দৃশ্য দেখলে উচ্ছ্বসিত হতেন। স্যারের দু’মেয়ে সাদাফ সিদ্দিকি ও নারগিস ইসলাম উপস্থিত থেকে অন্ততঃ দেখেছেন; এটাই সান্ত্বনা। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে প্রফেসর অঞ্জন কুমার চৌধুরী স্যার ধন্যবাদ পেতেই পারেন এ ধরণের আইডিয়া ও সফল আয়োজনের জন্য। ভবিষ্যতে এই সম্মেলনকে আমরা থাইল্যান্ডের এসটিটি’র আদলে নিয়ে যেতে পারে কিনা চিন্তা করা দরকার। যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে একজন নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে আসা সহ আর্থিক বিষয়ে। পাশাপাশি দেশের স্বনামধন্য অন্যান্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানও আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বা জামাল নজরুল ইসলাম রিচার্স সেন্টারের পক্ষে এ ধরনের আয়োজন সম্ভব না। জামাল স্যারের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে গাণিতিক পদার্থবিদ্যার ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালে। উক্ত সম্মেলনে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম সহ অধ্যাপক রজার পেনরোজ, অধ্যাপক জন টেইলর প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানী যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে, সম্ভবতঃ আর্থিক সহযোগিতার অভাবে ও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ আয়োজন চালিয়ে নেওয়া আর সম্ভব হয়নি। সেটার পুনরাবৃত্তি হোক তা কোন ভাবেই কাম্য না। এবারের আয়োজনে প্রশাসনের সহায়তায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ, উদ্যমী কিছু শিক্ষকরাই মূলতঃ এ প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে ছিলেন। প্রত্যাশা থাকবে তরুণদের জন্য সৃষ্টি করা এ প্ল্যাটফর্ম যেন দীর্ঘমেয়াদি হয়। একঝাঁক তরুণ গবেষকদের জন্য অভিনন্দন ও শুভকামনা।
লেখক : প্রফেসর, বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনীতিতে শিক্ষিত নাগরিকের ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে