চার বছর আগে লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার দায়ে হামলাকারীর যাবজ্জীবন এবং আরও একজনকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত; চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী টাইব্যুুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আসামিদের উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মমিনুর রহমান টিটু জানান।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হলেন ফয়জুল হাসান। চার বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন তার বন্ধু সোহাগ মিয়া। খালাস পেয়েছেন ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক ও ভাই এনামুল হাসান।
আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মমিনুর রহমান টিটু সাংবাদিকদের বলেন, বিচারক ফয়জুলকে যাবজ্জীবন সাজা ছাড়াও ৩০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ড ছাড়াও ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। মামলার বাদী মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন রায়ের পর সাংবাদিকদের সন্তোষ্টির কথা জানান। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোতাহির আলী বলেন, দণ্ডের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। খালাসপ্রাপ্তরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
শর্টকাটে বেহেশতের লোভে হত্যার চেষ্টা : উগ্রবাদী প্রচারে বেহেশত লাভের যে প্রলোভন দেখানো হয়, লেখক-অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তারই শিকার হয়েছিলেন বলে মনে করছে আদালত, যা তাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব পর্যবেক্ষণে বলেন, জাফর ইকবাল শিক্ষকতার বাইরে দেশের একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞান বিষয়ে ও শিশুতোষ গ্রন্থ লিখে তিনি জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা পালন করে চলছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে তার অবস্থান সর্বজনবিদিত।
প্রধান আসামি ফয়জুল হাসানের সঙ্গে দেশ বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্লগার ও নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলায় ফয়জুল তাকে নিজ হাতে হত্যার পরিকল্পা করেন; ইসলামের শত্রু ও নাস্তিক আখ্যায়িত করে হত্যার চেষ্টা চালান।
বিচারক বলেন, ফয়জুলের এহেন কাজ নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী কাজ, আরও স্পষ্ট করে বললে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’ ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু ভিন্নমত প্রকাশ এবং ভিন্নমত প্রকাশের জন্য এ দেশে হত্যকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ভিকটিমের উপর এহেন কার্য কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা স্বাধীন মত প্রকাশ পরমতসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা তথা সভ্যতার অগ্রগতির নির্ণায়ক। এগুলোর চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পেছনের দিকে হাঁটবে। স্বাধীন ও গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব।
অনলাইনে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা পর্যবেক্ষণে হয়, কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপ কৌশলে ভার্চুয়াল জগতে তাদের উগ্রবাদী সন্ত্রাসী মতবাদ ছড়িয়ে, সহজে বেহেস্ত যাওয়ার ‘শর্টকাট’ রাস্তা দেখিয়ে তরুণ প্রাণে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে। সাইবার জগতে এসব উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদানকারী বিভিন্ন সাইট বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে তাদের প্রচারিত তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরালো ও কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে।
২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায় মাদ্রাসা ছাত্র ফয়জুল হাসান। এ ঘটনায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে ওই দিন রাতেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন।