কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ দিয়ে আগামী জানুয়ারি মাসের
শেষের দিকে যান চলাচল শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তিনি গতকাল দুপুরে টানেলের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম টিউবের কাজের সমাপ্তি উপলক্ষে আগামীকাল (আজ শনিবার) একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এই সময় পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন, টানেল প্রকল্পের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. হারুনুর রশীদ সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আহমদ কায়কাউস জানান, আগামী জানুয়ারিতে টানেলের সব কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই টানেলটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে। তিনি বলেন, টানেলটি জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ০.১৬৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ৯৪ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। টানেল উদ্বোধনকে ঐতিহাসিক মাইলফলক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, টানেলটি চট্টগ্রামের যানজট পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি ঘটাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। দেশের মানুষ পদ্মা সেতুর পর আরেকটি মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সরকারপ্রধানের মুখ্যসচিব আরো বলেন, যেহেতু একটা টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে, এখন আমরা সেটার উদযাপন করছি। ঈদের আগে যেমন চাঁদরাত উদযাপন করি, এখন সেই চাঁদরাত এখানে। জানুয়ারিতে কাজ পুরোপুরি শেষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটার দুইটা টিউব আছে। একটার পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে পুরোপুরি।
প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আহমদ কায়কাউস বলেন, দুনিয়ার ভেতরে সব কি দাঁড়ি, কমা দিয়ে চলে? একটা বাস্তবতার ভিত্তিতে চলছে। যেটা ডিসেম্বরে শেষ করার কথা, সেটা জানুয়ারিতে শেষ হবে। এক-দুই মাসে তেমন কিছু হবে না।
প্রকল্পটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বলেন, এটা বাংলাদেশের জাতীয় বীরত্বের কাহিনী। একটা সময় নদী নিয়ে দুঃখের গান গাওয়া হতো। এখন সেই নদীর তলদেশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছেন। সেখানে যেমন দেশীয় বিনিয়োগ থাকবে, তেমন থাকবে বিদেশি বিনিয়োগ। আর তার জন্য দরকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ আর বন্দর। এর সঙ্গে মাতারবাড়ীর একটা সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া ঢাকার সঙ্গে কঙবাজার যাওয়ার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে যাচ্ছে। মুখ্যসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী ভালো জায়গায় নিয়ে গেছেন। কোনোভাবে এটা দমানো সম্ভব না।
একটা উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পত্রপত্রিকায় আপনাদের অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিল যে, বাংলাদেশের কী হবে। বাংলাদেশে যখন আইএমএফ আসছে, তখন তারা বাংলাদেশের প্রতিটা সেক্টর পর্যালোচনা করে দেখেছে। যদি মার্কিং করা হয় তাহলে বাংলাদেশ পাবে এ প্লাস। আর এটা এক দিনে পায়নি। বিভিন্ন নীতি ও উন্নয়ন থেকে হয়েছে। আর তারা এতে ইমপ্রেসড হয়েছে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলটি বাংলাদেশের গর্ব, মর্যাদা এবং একটি মেগা কাঠামো সম্পন্ন করার সক্ষমতার প্রতিফলন ঘটাবে। এক নগর, দুই শহর নকশার ভিত্তিতে চীনের সাংহাই নগরীর মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে নির্মাণ করার প্রকল্প নিয়েছে সরকার। টানেলের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক নেটওয়ার্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। কঙবাজার, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কর্ণফুলী টানেল দিয়ে আনোয়ারা ক্রসিং হয়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকায় গতি সঞ্চারিত হবে এবং জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হচ্ছে আগামীকাল (আজ শনিবার)। আমরা এটি উদযাপন করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হবেন। টানেল স্থলেও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন। তিনি আরও জানান, এখনো টানেলের কাজ পুরো শেষ হয়নি। পুরো কাজ সম্পন্ন করার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তারপরই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে টানেল।
উল্লেখ্য, চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ১০ হজার ৩৭৪কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে ১০ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের টিউব দুটির একটি থেকে অপরটির দূরত্ব প্রায় ১১ মিটার। নদীর তলদেশ থেকে টিউবের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৬ মিটার। টিউবের ভেতরের উচ্চতা ১৬ ফুট। দুই টিউবের প্রথম সংযোগ স্থাপনের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার, দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার এবং শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে ৪.৫মিটার। কোনো কারণে কোনো একটি সুড়ঙ্গেরভেতর দুর্ঘটনা ঘটলে সংযোগপথ দিয়ে নিরাপদে অন্য সুড়ঙ্গে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।