স্মরণাতীতকাল থেকে কক্সবাজার অর্থনৈতিকভাবে সুসমৃদ্ধ এলাকা। এর প্রাকৃতিক সম্পদ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাঁশ ও বেত শিল্প, মৃৎশিল্প, ঝিনুক শিল্প, লবণ শিল্প, হস্তশিল্পসহ নানাবিধ কুটিরশিল্প ছাড়াও কক্সবাজারের চিংড়ি–শিল্প হচ্ছে একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প। স্বাধীনতাত্তোর দেশের যে কয়টি খাত রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের মধ্যে মৎস্য খাত, বিশেষ করে উপকূলীয় চিংড়ি সম্পদ অন্যতম। কক্সবাজারের উন্নতমানের চিংড়ি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তৈরি পোশাক শিল্পের পরেই দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ হচ্ছে মৎস্যখাত, যার সিংহভাগই আসে চিংড়ি শিল্প থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বিগত কয়েক দশক যাবৎ ঘেরে চিংড়ি চাষ উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে এবং সম্ভাবনাময় উদীয়মান শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আঠারো শতকের সূচনালগ্নে বাংলা একটি সমৃদ্ধিশালী ও বর্ধিষ্ণু প্রদেশরূপে সুপরিচিত ছিল। এর বিপুল প্রাচুর্যের জন্যই এ দেশটিকে জান্নাতাবাদ বা স্বর্গরাজ্য, জান্নাতুল বালাদ বা শহরের স্বর্গ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হতো। বাংলার সম্পদের আকর্ষণেই দূরদূরান্ত থেকে বিদেশী বণিকেরা এর উপকূলে এসে ভিড় জমাতো। এ দেশের সম্পদ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে উর্বর মাটি; যেখানে ফলত ধান, গম এবং অন্যান্য শস্য, যেমন আখ, তুলা, আফিম, নীল এবং বিভিন্ন রকমের তেল ও সবজি জাতীয় কৃষিপণ্য। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যবান অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে এখানে উৎপন্ন হতো প্রচুর পরিমাণে লাক্ষা, মোম, লম্বা মরিচ, লবণ এবং শোরা। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে বাংলা হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন জাতের তুলা এবং সিল্কের তৈরি পণ্যের এক অসাধারণ ভাণ্ডার। এ পণ্য শুধু মোগলদের সাম্রাজ্য হিন্দুস্থানেই ব্যবহৃত হতো না, এ পণ্য যেত ব্রিটেন এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। পরবর্তীতে ঊনিশ এবং বিশ শতকে পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, চিনি শিল্পের উৎপত্তি, প্রসার এবং বাণিজ্যিকীকরণ ছিল বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অলোচ্য বিষয়। তদ্রুপভাবে পাকিস্তান আমলে কাগজ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, মানুষের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তনের ফলে পুরাতন শিল্পগুলোর জায়গায় স্থান করে নেয় নতুন নতুন শিল্প, যেমন– তৈরি পোশাক শিল্প। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ইতিহাসে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ। এদেশের বনজ ও মৎস্য সম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। খাদ্য রুচির পরিবর্তন, বৈশ্বিক চাহিদা, ভূ–প্রকৃতিগতভাবে উপকূলীয় অঞ্চল সুবিধা থাকায় এখানে মৎস্য সম্পদ বিশেষ করে চিংড়ি উদীয়মান শিল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়।
বর্ধিত জনগোষ্ঠীর প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণ, আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি শিল্পের ভূমিকা সুবিদিত এবং স্বীকৃত। বর্তমানে চিংড়ি শিল্পের সাথে প্রায় ১.৫ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আশির দশকে সীমিত পরিসরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ কার্যক্রমের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ উন্নয়নের পথ ধরে নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সরকারের কাছে এটি অগ্রাধিকার ও লাভজনক শিল্প হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে চিংড়ি এককভাবে অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
বাংলাদেশে একসময় বিভিন্ন নদ–নদী, খাল–বিল, উপকূলীয় অগভীর এলাকা ও গভীর সাগর থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করা হতো। এ দেশে প্রথম ১৯২৯–৩০ সালে সুন্দরবন অঞ্চলে চিংড়ি চাষের সূচনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৯৫০ সালের পূর্বে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে নদী সংলগ্ন এলাকায় মাটি দিয়ে পাড় বেঁধে ঘের বা পুকুর তৈরি করা হতো। ঘের বা পুকুরে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাদ্য থেকে চিংড়ি কয়েক মাসের মধ্যে বড় হলে তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করা হতো। ১৯৫০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উপকূলীয় বন্যা প্রতিরোধ ও পানি নিষ্কাশন উপকূলীয় বাঁধ তৈরির পরপরই দেশের সনাতন পদ্ধতির চিংড়ি চাষ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
ষাটের দশকে দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে বিভিন্ন আকারের বহুসংখ্যক পোল্ডারের সৃষ্টি হয়। এর আগে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় নিম্নভূমি ছিল প্রকৃতপক্ষে উপকূলীয় মৎস্য ও চিংড়ির প্রাকৃতিক আবাসস্থল। পোল্ডার সৃষ্টির পর প্রাথমিক পর্যায়ে সেগুলোতে ধানের চাষ সম্প্রসারিত হয়। ফলশ্রুতিতে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে প্রাকৃতিক মৎস্য ও চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হয়। ঐ সময় দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের কোনো কোনো পোল্ডারে শুধু লবণ চাষ এবং অল্প কিছু এলাকায় ধান চাষ হতো। সত্তরের দশকে এই পোল্ডারগুলোতে লোনাপানি ধরে রেখে চিংড়ি চাষের সূচনা হয়। সত্তর দশকের পর বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের অভ্যন্তরে পুনরায় চিংড়ি চাষের সূচনা হয়। বস্তুত চিংড়ি চাষ তখনো বিজ্ঞানসম্মতভাবে চালু হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে লালন–পালন করা হয়। খুলনা, বাগেরহাট, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এই চিংড়ি চাষ পরবর্তীতে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক অমিত সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। স্বাধীনতাত্তোর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৭৬ সালে কক্সবাজারের সন্নিকটে খুরুশ্কুল এবং চকরিয়ায় প্রথম বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে বাগদা চিংড়ির আধুনিক চাষ শুরু হয়। উপকূলীয় জেলাসমূহের মধ্যে কক্সবাজার এলাকায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে লবণ উৎপাদন মাঠে স্থানীয় জনগণ বহুদিন হতে বিক্ষিপ্তভাবে ছোট আকারের ঘোনায় চিংড়ি চাষ করে আসছে। চকরিয়া উপজেলার পালাকাটা, রামপুরা, চরণদ্বীপ ও রিং ভং মৌজায় প্রায় ৫০০০/৬০০০ হেক্টর (১৩–১৪ হাজার একর) জোয়ার প্লাবিত ভূমি বন বিভাগের সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু এই এলাকায় অর্থকরী বন সৃষ্টি সম্ভব হয়নি বিধায় সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল নগণ্য। এ সব জমি চিংড়ি চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে মৎস্য বিভাগ প্রাথমিকভাবে ২০২৪ হেক্টর (৫০০০ একর) ভূমি বার্ষিক হেক্টর প্রতি ২৪৭ টাকা (একর প্রতি ১০০ টাকা) খাজনায় ৩৯ জন উৎসাহী ও আগ্রহী চিংড়ি চাষিদের মধ্যে অস্থায়ী বন্দোবস্তী প্রদান করে। ১৯৮৫–৮৬ সালে উক্ত এলাকাসমূহ ১০ একর প্লটে পরিণত করে বার্ষিক হেক্টর প্রতি ৩৭০৫ টাকা (একর প্রতি ১৫০০ টাকা) খাজনায় উৎসাহী ও আগ্রহী চিংড়ি চাষিদের মধ্যে ১০ বৎসর মেয়াদী বন্দোবস্তী প্রদান করা হয়।
১৯৮২ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থানুকূল্যে মৎস্য বিভাগের মৎস্য চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) দুইটি উপ–প্রকল্প কক্সবাজারে গ্রহণ করা হয়। এদের মধ্যে একটি স্বাদু পানির চিংড়ি (গলদা) পোনা উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজারস্থ বিমান বন্দরের নিকট অবস্থিত এবং উপ–প্রকল্পের আওতায় চকরিয়া উপজেলার রামপুরায় বাগদা চিংড়ির একটি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়। একই সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রদর্শনী চিংড়ি চাষ প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজারে একজন খামার ব্যবস্থাপক নিয়োগ করা হয় এবং পরবর্তীতে কক্সবাজারের বাঁকখালীতে চিংড়ি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়।
চিংড়ি চাষের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর বিশ্ব ব্যাংক এর অর্থানুকূল্যে ১৯৮৫–৮৬ সালে চিংড়ি চাষ প্রকল্প (আই.ডি.এ.) নামে একটি প্রকল্পের কাজ কক্সবাজারে শুরু করে। এ প্রকল্পে চিংড়ি চাষ এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ চিংড়ি চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। এ সময় কক্সবাজার জোনে একটি সম্প্রসারণ ইউনিট, একটি প্রদর্শনী খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং বাগদা চিংড়ি প্রজনন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া চিংড়ি পোনা উৎপাদনের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় ৯টি বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়।
১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় মৎস্য চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিবি) আওতায় কক্সবাজার জেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ১০–২৫ একর বিশিষ্ট মোট ৩৬টি চিংড়ি খামারে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে একটি সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এছাড়া সমুদ্রের পাড় হতে পোনা ধরার পদ্ধতির উন্নতি সাধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। চিংড়ি চাষের ব্যাপকতা অনুধাবন করে কয়েকটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চিংড়ি চাষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে চিংড়ি চাষ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করে। এদের মধ্যে মেসার্স আল্লাহ ওয়ালা লিমিটেড, মেসার্স বেক্সিমকো ফিশারিজ লিমিটেড, একোয়াকালচার ফার্ম লিমিটেড, মেসার্স মেঘনা ফিশারিজ লিমিটেড এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
চিংড়ি শিল্পের কয়েকটি চাষ পদ্ধতি রয়েছে। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও দ্বৈতয়িক উৎসের মাধ্যমে নিম্নোক্ত তিনটি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। (ক) এককভাবে চিংড়ি চাষ : একক চিংড়ি চাষ বলতে প্রধানত উপকূলীয় এলাকার বাগদা চিংড়ির চাষকেই বোঝায়। যেখানে জোয়ার–ভাটার প্রভাব রয়েছে সে এলাকা একক চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। কক্সবাজার জেলার চিংড়ি খামারগুলির অধিকাংশই বাঁধের ভেতরে অবস্থিত। এগুলি এককভাবে চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। (খ) পর্যায়ক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ : এ পদ্ধতিতে ঘেরের ভেতরে পুকুরে পালক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ করা হয়। শীত মৌসুমে ঘেরের ভেতর জোয়ারের পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ এবং বর্ষার আগে চিংড়ি আহরণ করে একই ঘেরে ধান ও অন্যান্য মাছ চাষ করা হয়। (গ) পর্যায়ক্রমে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ : পর্যায়ক্রমে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় পর্যায়ক্রমে একই জমিতে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষের প্রথা চালু আছে। এখানে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদন করা হয়। মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চিংড়ি চাষ করা হয়।
এছাড়া পানির লবণাক্ততার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের চিংড়ি চাষকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যেমন : অল্প লোনাপানির চিংড়ি চাষ ও স্বাদু পানির চিংড়ি চাষ। বস্তুত বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ বলতে অল্প লোনাপানির চিংড়ি চাষকেই বোঝায়। উপকূলীয় এলাকায় চাষকৃত চিংড়ি প্রজাতির মধ্যে বাগদা চিংড়ির গুরুত্ব বেশি যা অল্প লোনাপানিতেই চাষ করা হয়। মোট উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগই বাগদা চিংড়ি। স্বাদুপানিতে এখনো ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয়নি। দেশে স্বাদু পানিতে চাষ উপযোগী চিংড়ি হচ্ছে গলদা চিংড়ি। কৃত্রিম উপায়ে এখন কক্সবাজার, চট্টগ্রামের পটিয়া, নোয়াখালীর ব্যাকইয়ার্ড হ্যাচারি এবং আরও কয়েকটি হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে।
চিংড়ি সম্পদের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের দিক থেকে কক্সবাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগরের বিপুল লবণাক্ত জলরাশির পাশাপাশি উপকূলীয় অর্ধ–লবণাক্ত পানি এবং অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের স্বাদু পানির সম্মিলিত উপস্থিতির ফলে এ জেলা চিংড়ির বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজার জেলায় বাগদা চিংড়ির সর্বমোট খামার ৩৮৮৭টি (৯১,৯৪৬.৭৪ একর)। মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন চিংড়ি খামার ৭০০০ একর। খাস খতিয়ানভুক্ত চিংড়ি খামার ২৫,০৭৪.৯৫ একর। অর্ধ–নিবিড় বাগদা চিংড়ি খামার ৬টি (৩১.৯৬ একর)। বাগদা চিংড়ির উৎপাদনের হার সাধারণ খামারে ১৫০–২০০ কেজি/একর (বার্ষিক) এবং অর্ধ–নিবিড় খামারে ২–৩ টন/একর (বার্ষিক)। মৎস্য হ্যাচারি আইন ২০১০ এর আওতায় ডিসেম্বর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিবন্ধিত বাগদা চিংড়ি হ্যাচারি ৪৩টি, গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ১টি। বার্ষিক বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন ৮–৯ শত কোটি। চিংড়ি ডিপো ৩৭২টি। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ৬টি (৩টি ই.উ. অনুমোদিত)। চিংড়ির মোট উৎপাদন ২৫০০০ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি বার্ষিক উৎপাদনও ৩০০/৪০০ কেজি থেকে ইতোমধ্যে ৮০০০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাধীন রামপুর মৌজায় মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৭০০০ একর জমিতে ১০ একর বিশিষ্ট ৩৪২টি, ১১ একর বিশিষ্ট ১১৯টি, ৩০ একর বিশিষ্ট ৩২ টি এবং ৩০০ একর বিশিষ্ট ১ টি চিংড়ি প্লট সম্প্রতি ৫২৩ জন চিংড়ি চাষিদের নিকট ৩য় ধাপে ২০ বৎসর মেয়াদে ইজারা প্রদানের মেয়াদ নবায়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। উক্ত চিংড়ি প্লটসমূহে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক ও রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রমের পাশাপাশি উন্নত পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
চিংড়িতে ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তকরণ এবং চাষিদের ভাইরাসমুক্ত বাগদা চিংড়ি পি.এল. প্রাপ্তি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার সদরে অবস্থিত কলাতলী হ্যাচারি জোনে মৎস্য অধিদপ্তরের পি.সি.আর. ল্যাবরেটরি স্থাপিত হয়েছে। চিংড়ি সম্পদকে ভাইরাসমুক্ত করার উদ্দেশ্যে চিংড়ি পোনা উৎপাদনের নিমিত্ত ভাইরাসমুক্ত মা (মাদার) চিংড়ির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই থেকে ভাইরাসমুক্ত SPF (Specific Pathogen Free) মা চিংড়ি আমদানি করে এর উন্নয়নের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় একটি চিংড়ি হ্যাচারিকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের নিবিড় মনিটরিং এ সম্প্রতি উক্ত হ্যাচারিতে ২য় প্রজন্মের পোনা থেকে মা চিংড়ি উন্নয়নের কাজ চলছে। এর পাশাপাশি উক্ত কার্যক্রমের আওতায় উৎপাদিত ভাইরাসমুক্ত SPF চিংড়ি পি.এল. বিভিন্ন অর্ধ–নিবিড় চিংড়ি খামারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যতম নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ সুন্দরবন, লবণ, চিংড়ির উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা। এ উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আয়তন জুড়ে বিস্তৃত জমিতে চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মৎস্য চাষে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ। ১৯৮৪ সালে মেসার্স আল্লাহ ওয়ালা লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব আবুল কাশেম জেলায় সর্বপ্রথম চিংড়ি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রন হ্যাচারিতে ১৪০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করেন। চকরিয়ার মৎস্য জোনে উৎপাদিত চিংড়ি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চকরিয়ার আর্থ–সামাজিক অবস্থার বিনির্মাণ এবং আর্থিক সচ্ছলতার স্তম্ভ হয়ে ওঠে চিংড়ি। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্যটন নগরী ও সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের প্রবেশদ্বার চকরিয়া উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ‘সাদা সোনা’ হিসেবে খ্যাত ঐতিহ্যের ধারক দৃষ্টিনন্দন বাগদা ‘চিংড়ি ভাস্কর্য’ চকরিয়ার পৌর মেয়রের উদ্যোগে চকরিয়া পৌরসভা কার্যালয়ের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়। ভাস্কর্যে তিনটি চিংড়ির প্রতিকৃতি স্থান পায়। কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার ঐতিহ্য বহনকারী এই চিংড়ি ভাস্কর্যটি ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়।
চিংড়ির উৎপাদন ধারা: ২০১৮–১৯ অর্থবছরে মোট চিংড়ির উৎপাদন ছিল প্রায় ১,২৫,১১০ মে. টন। আর উৎপাদিত চিংড়ির ৪০ হাজার মে. টন চিংড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে এবং অবশিষ্টাংশ অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মিটিয়েছে। এ অর্থবছরে কক্সবাজারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১৩,২৯৮.৮৫ মে. টন। এর মধ্যে বাগদা ১০,৯২৫.৬০, গলদা ৩৮০.৫০ এবং অন্যান্য চিংড়ি ১,৯৯২.৭৫ মে. টন। ২০১৯–২০ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির মোট উৎপাদন ১,২৭,৬০১ মে. টন। তৎমধ্যে কক্সবাজারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১১,৬১৯.৩০ মে. টন। এর মধ্যে বাগদা ৯,০৮৫, গলদা ১৫৬.৩০ এবং অন্যান্য চিংড়ি ২,৩৭৮ মে. টন। ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির মোট উৎপাদন ১,৩১,৫০৯ মে. টন। এই অর্থবছরে কক্সবাজারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১৬,০৫১.৩০ মে. টন। এর মধ্যে বাগদা ১৩,৩৪৩, গলদা ২৭৯.৩০ এবং অন্যান্য চিংড়ি ২,৪২৯ মে. টন। ২০২১–২২ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির মোট উৎপাদন ১,৩৭,০২১ মে. টন। এই অর্থবছরে কক্সবাজারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১৭,২০২.২৮ মে. টন। এর মধ্যে বাগদা ১৪,৩৯৪.৫৫, গলদা ২৯০.৯৮ এবং অন্যান্য চিংড়ি ২,৫১৬.৭৫ মে. টন। ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির মোট উৎপাদন ১,৪৪,৩৫২ মে. টন। এই অর্থবছরে কক্সবাজারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১৭,৭৩২.৬১ মে. টন। এর মধ্যে বাগদা ১৪,৯৬৩.১০, গলদা ২৩৪.০১ এবং অন্যান্য চিংড়ি ২,৫৩৫.৫০ মে. টন।
চিংড়ি থেকে রপ্তানি আয়: স্বাধীনতার পর হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২.৩৮ কোটি টাকা। অত:পর সরকারের মৎস্য খাতে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই বৃদ্ধি পায়। যার ফলশ্রুতিতে এ খাতে রপ্তানি আয় ২০১৩–১৪ অর্থ বছরে ৬৩৮.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫০০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। মৎস্য অধিদপ্তর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য মতে, ২০১৪–১৫ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয় ৫৬৮.০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫–১৬ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৫৩৫.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬–১৭ অর্থবছরে আয় হয় ৫২৬.৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে আয় হয় ৫০৮.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৫০০.৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৯–২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪৫৬.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০–২১ অর্থবছরে ৪৭৭.৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২১–২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪০ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশের ৪,১৫৪ কোটি টাকা। আর ২০২২–২৩ অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩০ কোটি ২ লাখ মার্কিন ডলার।
মৎস্য অধিদপ্তর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য মতে, ২০১৫–১৬ অর্থবছরে কক্সবাজার চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করেছিল ৫৫ কোটি ৯৩ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬–১৭ অর্থবছরে আয় হয় ৫৯ কোটি ৮৭ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে আয় হয় ৫২ কোটি ৮২ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৫৩ কোটি ১৯ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৯–২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪১ কোটি ৫৩ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০–২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৫৮ কোটি ২৬ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১–২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪৪ কোটি ৩৬ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২২–২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৩২ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
চিংড়ি একটি সুস্বাদু উপাদেয় খাদ্য। চিংড়িতে প্রোটিন, ফ্যাট ও খনিজ উপাদানের একটি স্বাস্থ্যকর ও সুষম অনুপাত বিদ্যমান রয়েছে। অন্যান্য মাছ ও মাংসের চেয়ে চিংড়িতে ক্যালরি কম থাকায় ওজন বাড়ার সম্ভাবনা কম। রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। এছাড়া প্রায় ১৪% ফসফরাস আছে যা মানবদেহের দাঁত ও হাঁড়কে মজবুত রাখে। চিংড়িতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকায় শরীরে কোন ক্ষত সৃষ্টি হলে তা দ্রুত সারাতে সাহায্য করে। প্রায় ১৪% কপার আছে যা থাইরয়েডজনিত সমস্যা দূর করে এবং মানবদেহের গ্রন্থির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে ও থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা সহনীয় রাখে। চিংড়িতে ৮% ম্যাগনেসিয়াম আছে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং প্রায় ৫৭% সেলিনিয়াম আছে যা শরীরে ক্যান্সার কোষ সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়। আবার চাহিদার প্রায় ২৫% ভিটামিন বি–১২ পাওয়া যায় চিংড়ি থেকে যা রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে ও রক্ত স্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। চিংড়িতে ভিটামিন বি–১২ ও ওমেগা–৩ ফ্যাটি এসিড থাকায় হৃদপিন্ড সুস্থ রাখে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এমনকি লিভার ভাল রাখতেও সাহায্য করে। তবে যাদের শরীরে এলার্জি রয়েছে তাদের চিংড়ি খেতে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
চিংড়ি শিল্পের বর্তমান অবস্থা: দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত হিমায়িত চিংড়ি। একসময়ে পোশাক খাতের পরই ছিল এর অবস্থান। এখন সপ্তম স্থানে নেমে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০৫টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ২৮টি টিকে আছে এবং বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন। কাঁচামাল স্বল্পতার কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০–১৫ শতাংশ, যা কারখানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুকূল নয়। দেশীয় চিংড়ি তথা বাগদা চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ায় ১১টি প্রতিষ্ঠান ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের কারিগরি কমিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো, সক্ষমতা, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং কারিগরি কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর কক্সবাজারের ৩টি ও চট্টগামের ১টি চিংড়ি হ্যাচারিকে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি এবং এক বছরের মধ্যে কার্যμম শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: কক্সবাজারের উখিয়ার এম. কে. হ্যাচারি, কলাতলি এলাকার নিরিবিলি হ্যাচারি ও খুরুশকূল এলাকার মিডওয়ে সায়েন্টিফিক ফিশারিজ লিমিটেড ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ডাফা ফিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড। দেশীয় চিংড়ি শিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আমাদের আশা জাগাচ্ছে বাগদা চিংড়ির ১৮ মে ২০২২ সালে জিআই সনদ লাভ। বাগদা চিংড়ি জিআই সনদ পাওয়ার দুটো সুবিধা – বিশ্ব বাজারে আমাদের নিজস্ব পণ্য হিসেবে ৩০ শতাংশ বেশি মূল্য পাব এবং এখন এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ হবে। চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার ৮টি উপজেলায় প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে।
চিংড়ি শিল্পের অপরিকল্পিত বিকাশ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ: সাম্প্রতিক কালে অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পরিবেশের ক্ষতির মধ্যে মাটি ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া, জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া, স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া, বিশুদ্ধ পানির অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে চকরিয়ায় সুন্দরবন তথা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বা প্যারাবন রয়েছে। প্যারাবন উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানির পুষ্টিচক্র সমাধান করে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে। উপকূলীয় জোয়ার–ভাটার স্বাদু ও লবণ পানির মিশ্রণ স্থলে প্যারাবন বিশেষ করে বাস্তুসংস্থানগত ভারসাম্যতায় সামুদ্রিক জীবদের খাদ্য আহরণ ও বেঁচে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি করে। কক্সবাজার অঞ্চলের অধিকাংশ প্যারাবন চিংড়ি চাষের কারণে ধ্বংস হয়। অধিকন্তু জোয়ারের পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। এ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় নানা কর্মকাণ্ডের ফলে যেমন: চিংড়ি ঘেরের অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ, ঘেরে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ত পানির প্রবেশ, জলাবদ্ধতা, নদী ও খালে লবণাক্ত পানির প্রবাহ, চিংড়ির অধিক বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত লবণ দেওয়া। এ সকল কারণে ভূমির উপরে–নিচে মাটি ও পানির লবণাক্ততা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, ফল এবং সবজির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। চিংড়ি চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে শস্যের উৎপাদন এবং মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণও হ্রাস পায়। এক সময় যে জমিতে ধান–পাটের চাষ হতো, পলিযুক্ত দোঁআশ মাটি ছিল তা ধীরে ধীরে লবণাক্ত পানির নিচে চলে যাচ্ছে। তাই পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, চকরিয়ার সুন্দরবন তথা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষা, চিংড়ি চাষে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হ্রাসকরণ এবং সর্বোপরি জমিতে লবণাক্ততা যাতে বৃদ্ধি না পায়, সেজন্য জোয়ারের পানি প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
চিংড়ি শিল্পের উন্নয়নে সুপারিশমালা: মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্তমান প্রতিযোগিতায় দেশে অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের সাথে সাথে চিংড়ি শিল্পের উন্নয়নও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কক্সবাজারের স্থানীয় চিংড়ি উৎপাদক, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, চিংড়ি বিশেষজ্ঞ, চিংড়ি চাষি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মতে এ শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে । যেমন: নিবিড় চিংড়ি চাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন; ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির চাষের অনুমোদন; মৎস্য হ্যাচারি আইন ২০১০ বাস্তবায়ন; চিংড়ি সেক্টরের জন্য বাজেট বরাদ্দ; যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানির উপর শূন্য ট্যাক্স ধার্য; চিংড়ি চাষের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার অন্যান্য কৃষি পণ্যের ন্যায় ৪% ও বিদ্যুৎ বিল কৃষি পণ্যের অনুরূপ করা; চিংড়ি চাষ এলাকার সামাজিক অবস্থা ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন জরুরি; চিংড়ির মান নিয়ন্ত্রণে চিংড়ি আহরণ থেকে শুরু করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত দুষণমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা; নতুন নতুন প্রযুক্তি বিষয়ে অব্যাহত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও তথ্যবহুল সম্প্রসারণ পুস্তিকা প্রণয়ন এবং চিংড়ি সম্পদ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা।
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চিংড়ি খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি আয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ খাতের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, কারিগরি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ, লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ কৌশল গ্রহণ খুবই জরুরি। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নে উন্নত প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অর্জিত জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা দরকার। সীমিত সম্পদের এই দেশটিতে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিবেশ সম্মত চিংড়ি চাষের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা গেলে কক্সবাজারের চিংড়ি–শিল্প আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ গেজেট, কক্সবাজারের ইতিহাস, Yearbook of Fisheries Statistics of Bangladesh, Fisheries Information Bulletin, সরেজমিনে পরিদর্শন, মৎস্য অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।
লেখক : গবেষক; সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।