চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, বাংলাদেশের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক রূপ তুলে ধরার এক অনন্য কেন্দ্র হলেও সময়ের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায় দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রচার–প্রচারণার অভাব, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনুপস্থিতি এ অবনতির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এছাড়া প্রসারে রয়েছে আর্থিক বরাদ্দে স্বল্পতা ও জনবল সংকটও। জাদুঘর শুধু পুরাতন বস্তু সংরক্ষণের স্থান নয়– এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, একটি জ্ঞানভাণ্ডার, একটি সময়ের দলিল। এখানে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিল্প একে অপরের সঙ্গে মিলে এক অনন্য সম্মিলন গড়ে তোলে। জাদুঘর আমাদের অতীত দেখায়, বর্তমান বুঝায় এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা দেয়।
আজ আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। বিশ্বব্যাপী জাদুঘরের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য দিনটি প্রতি বছর ১৮ মে পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘The Future of Museums in Rapidly Changing Communities’ বা ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’, যা বর্তমান বিশ্বে জাদুঘরের বহুমাত্রিক ভূমিকা ও প্রভাবকে তুলে ধরার এক শক্তিশালী বার্তা। এবারের প্রতিপাদ্যটি বহুবিধ অর্থ বহন করে। এটি শুধু ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা নয় সমাজে পরিবর্তন আনার, ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করার, এবং গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ক্ষমতাও প্রকাশ করে। আজকের এই দিনে আমাদের দায়িত্ব শুধু জাদুঘর পরিদর্শনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাদুঘরকে সমাজের অগ্রগতির সহযাত্রী হিসেবে দেখা এটাই হওয়া উচিত দিবসটির মূল বার্তা। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে ৮টায় র্যালি আয়োজন করা হয়েছে। র্যালিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করবে।
আন্তর্জাতিক কাউন্সিল অব মিউজিয়ামস (ওঈঙগ) ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে তাদের আহ্বানে প্রথমবারের মতো পালিত হয় আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। সেই থেকে প্রতিবছরই দিবসটি পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৮০টি দেশের প্রায় ২৮ হাজার জাদুঘর আইসিওএম–এর সদস্য হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দিবসটি এখন একটি আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি–চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে জাদুঘরের পরিচিতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে নগরবাসীর মধ্যে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও জনসমাগম স্থলে ডিজিটাল স্ক্রিনের মাধ্যমে জাদুঘরের প্রদর্শনীগুলো প্রচার করা হলে আগ্রহ বাড়তে পারে। আধুনিক বিপণন কৌশল ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ডিজিটাল ক্যাম্পেইন চালানোও সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভর। তাই তাদের আকর্ষণ করতে হলে ডিজিটাল ইন্টার্যাকটিভ প্রদর্শনী, ভার্চুয়াল ট্যুর, থ্রিডি এনিমেশন এবং এআর/ভিআর প্রযুক্তির ব্যবহার আবশ্যক। পুরাতন সংগ্রহকে আধুনিক ফরম্যাটে উপস্থাপন করলে শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই এর গুরুত্ব বহুগুণে বাড়বে। বর্তমানে জাদুঘরটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষিত জনবল নেই। এটি কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও মান বজায় রাখতে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অতিরিক্ত আর্থিক বরাদ্দ এবং দক্ষ মানবসম্পদ নিয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা জরুরি।
উন্নত ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, বরং একটি শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। স্থানীয় সংস্কৃতি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং জাতিগত বৈচিত্র্য সংরক্ষু ও উপস্থাপনার মাধ্যমে এটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
দর্শনার্থী আরশাফ উদ্দিন বলেন, প্রথমবার জাদুঘরটি ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা আমার জন্য সত্যিই দারুণ ছিল। বাংলাদেশের নানা ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার এমন একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রয়েছে– এটা অনেকেই জানেন না, যা দুঃখজনক। তবে আমি মনে করি, পরিবেশটি আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হলে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আরও শিক্ষুীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারত। ভার্চুয়াল ট্যুর কিংবা ইন্টার্যাকটিভ ডিসপ্লের মতো প্রযুক্তি যুক্ত হলে জাদুঘরটি শিক্ষার এক অসাধারণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
দর্শনার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিশ্বের অনেক জাদুঘর দেখেছি, তবে চট্টগ্রামের এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর একেবারেই আলাদা ও ব্যতিক্রমধর্মী। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের যে প্রচেষ্টা এখানে দেখা যায়, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তবে বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য আরও ব্যাখ্যামূলক ইংরেজি তথ্য, গাইড এবং প্রযুক্তিনির্ভর উপস্থাপনা থাকলে অভিজ্ঞতাটি আরও সমৃদ্ধ হতো। পাশাপাশি, এর প্রসারে আরও প্রচার–প্রচারণার প্রয়োজন আছে, যেন দেশের বাইরের মানুষও এই অসাধারণ জাদুঘর সম্পর্কে জানতে পারে।
নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বাদমতলী সংলগ্ন ১.২৫ একর জমিতে অবস্থিত জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি দেশের অন্যতম দর্শনীয় ও গবেষণাগারমূলক স্থানটি। এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনধারার পরিচয় তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়া মহাদেশে মাত্র দুটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের মধ্যে এটি একটি, অন্যটি জাপানে অবস্থিত।
এই জাদুঘরটি ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। এরপর ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে এতে আরও দুটি প্রদর্শনী কক্ষ যুক্ত করা হয়।
জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় ২৫টি ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহৃত দুর্লভ সামগ্রী–যার অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। এদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বম, খিয়াং, খুমি, চাক, রাখাইন, পাংখোয়া; সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মনিপুরী, পাঙন, পাত্র; ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, হাজং, দালু, মান্দাই, কোচ; রাজশাহী–দিনাজপুর অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, পলিয়া; এবং যশোর–ঝিনাইদহ অঞ্চলের বুনো বা বোনা ও বাগদি গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য।
জাদুঘরে রয়েছে ৪টি গ্যালারি ও একটি হলরুম। প্রথম তিনটি গ্যালারিতে স্থানীয় নৃ–গোষ্ঠীর অস্ত্র, পোশাক, অলংকার, নৌকা, বাঁশের তৈজসপত্রসহ নানা সামগ্রী প্রদর্শিত হয়েছে। চতুর্থ গ্যালারিতে ভারত, পাকিস্তান, কিরগিজস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির কিছু জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে। হলরুমে মানচিত্র ও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে নৃ–গোষ্ঠীগুলোর উৎসব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি বিশেষ আকর্ষণ হলো, এখানে ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা বার্লিন প্রাচীরের একটি টুকরো সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘরের সামনেই রয়েছে একটি সবুজ ও ছায়াময় বাগান যা পরিবেশকে করে তোলে আরও মনোমুগ্ধকর।
এই জাদুঘরটি রবিবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন খোলা থাকে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ দেশি–বিদেশি দর্শনার্থী ও গবেষক এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপ–পরিচালকের কাম–কীপার মো. আমিরুজ্জামান বলেন, এবারের প্রতিপাদ্য ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’ আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে এসেছে। আজকের জাদুঘর কেবল ঐতিহ্য সংরক্ষণের কেন্দ্র নয়, বরং এটি গবেষণা, শিক্ষা, ও সামাজিক সংলাপের এক প্রাণবন্ত ক্ষেত্র।