জশন শব্দটি আরবি, অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব, আর জুলুস শব্দটিও আরবি বহুবচন, তার একবচন জলসা অর্থ বসা, উপবেশন। তবে এখানে মিছিল, র্যালী অর্থে। ইদ অর্থ খুশি, মিলাদুন্নবি অর্থ নবির জন্ম। সুতরাং জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবি অর্থ নবি মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে মিছিল বা শোভাযাত্রার মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করা বা খুশি উদযাপন করা।এটা শরীয়ত সম্মত উত্তম আমল। নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আন্তরিক মুহাব্বত বা ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশের উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করা।
হযরত বারাহ (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন মহানবি (া) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনার সীমানায় প্রবেশ করলেন, তখন মদিনার নারী – পুরুষ, ছোট বড় ছেলে মেয়ে সকলে মদিনার রাস্তায়, অলিগলিতে সারিবদ্ধভাবে দাড়িঁয়ে গেলেল, অনেকে ঘরের ছাঁদে উঠলেন, আর নবি (দ.) কে স্বাগত জানিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন– (তলায়াল বাদরু আলাইনা, মিন ছানি ইয়াতিল ওয়াদায়ী, ওয়াজাবাত শুকরু আলাইনা মাদায়া লিল্লাহিদা) পূর্ণিমার চাঁদ (বিশ্বনবী দ.) আমাদের ওপর উদিত হয়েছে ওয়া’দা উপত্যকা থেকে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য, যতদিন আল্লাহকে ডাকার মত কেউ থাকবে। অনেকে বলছে মারাহাবা ইয়া মুহাম্মদ, মারহাবা ইয়া রাসুলুল্লাহ। (সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, হাদিসুল হিজরত অধ্যায়)। উক্ত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনে আনসার সাহাবীগণ, মদিনার সাধারণ মানুষগণ ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া মুহাম্মদ স্বাগতম প্রভৃতি শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো। নবির আগমনে বিভিন্ন নাত, প্রশংসা মূলক কবিতা প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁরা র্যালী, শোভাযাত্রা করলেন। আমরাও সাহাবিগণের অনুসরণে নবি (দ.) এর শুভাগমণের মাস রবিউল আউয়াল আসলে জশনে জুলুস করি, আনন্দ মিছিল করি, ইয়া নবি সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুলুল্লাহ, বালাগাল উলা বিকামালিহি প্রভৃতি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে আনন্দ প্রকাশ করি।
এখানে পার্থক্য হচ্ছে সাহাবীগণ রাসুলুল্লাহ (দ.) কে মদিনায় পেয়ে খুশি উদযাপন করেছেন। আর আমরা নবি প্রেমিকরা নবির শুভাগমনে রবিউল আউয়াল মাস আসলেই জশনে জুলুস করি, আনন্দ উৎসব করি, নবির শানমান, মর্যাদা আলোচনার মাহফিল করে থাকি। নবির শুভাগমনে খুশি উদযাপন করা মহান আল্লাহর হুকুম। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, কুল বিফদলিল্লাহে ওয়া বিরহ্মাতিহি ফাবিজালিকা ফাল ইয়াফরাহু হুয়া খায়রুন মিম্মা ইয়াজমাহুন। (সুরাহ ইউনুস,আয়াত:৫৮)। তরজুমা: হে নবি (দ.) আপনি উম্মতদের বলেদিন, তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ পেয়ে খুশি উদযাপন কর। আর এটা তোমদের অপরাপর সকল আমলের চেয়ে উত্তম। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) তার বিখ্যাত কিতাব ‘তাফসির দুররে মানসুর‘ এর ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা:৩৬৭, সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির ইবনে আব্বাস (র.) এর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘বিরহমাতিহি‘ থেকে উদ্দেশ্য নবি মুহাম্মদ এবং উক্ত কিতাবের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় ‘ফাদলিহি‘ থেকে উদ্দেশ্যে নবি মুহাম্মদ (দ.)। সুতরাং অত্র আয়াতে ফজল ও রহমত উভয় শব্দ দ্বারা নবি মুহাম্মদ (দ.) কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। উক্ত আয়াতের অর্থ হবে, হে নবি (দ.)আপনি উম্মতদের বলে দিন, তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে নবি মুহাম্মদ (দ.) কে পেয়ে খুশি উদযাপন কর। আর তোমাদের এ খুশি উদযাপন, অপরাপর সকল ইবাদত থেকে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা সুরাহ আলে–ইমরানের ১৮৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, (লাকাদ মান্নালল্লাহু আলাল মুমিনিনা ইজ বায়াছা ফি হিম রসুলান) তরজুমা: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের মাঝে মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে অনেক দয়া করেছেন।
সুরাহ আম্বিয়া, আয়াত:১০৭ এ ইরশাদ করেন, (ওয়ামা আরসালনা কা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন)। তরজুমা: আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। উল্লিখিত কুরআনের আয়াত গুলোর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, নবি করিম (দ.) হচ্ছেন, আল্লাহর ফজল ও রহমত, যা পেয়ে খুশি উদযাপনের জন্য কুরআনের নির্দেশ। কাজেই এই রহমত নবির শুভাগমনের দিন ইসলামি শরীয়ত সম্মত খুশি উদযাপন করা নিঃসন্দেহে জায়েজ এবং বরকতময় কাজ। প্রচলিত নিয়মে জশনে জুলুসে ইদে মিলাদুন্নবি া পালন করাকে কতেক মৌলভী বিদয়াত, না জায়েজ মনে করেন। প্রকৃত পক্ষে তা বিদয়াত নয়, হতে পারে না বরং সুন্নাত।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যাক্তি ইসলামে কোনো (সুন্নাত) পদ্ধতি বা রীতি আবিষ্কার করলো,তাঁর আমল নামায় সাওয়াব লিখা হবে। আর এই রীতি যারা পালন করলো, তাদের আমলনামায় যে পরিমাণ সাওয়াব লিখা হবে, অনুরুপ সাওয়াব রীতি আবিষ্কার কারিও প্রাপ্ত হবে, এতে কোনো অংশে সাওয়াব কমানো হবে না। আবার কেউ কোনো মন্দ রীতি (বিদয়াত) চালু করলো, তাহলে তার আমলনামায় গুনাহ লিখা হবে। যারা পালন করবে তারাও গুনাহগার হবে, আর বিদয়াত প্রচলন কারীও অনুরুপ গুনাহর অংশের ভাগ প্রাপ্ত হবে। (মিশকাত শরীফ)
ইসলামের মধ্যে যে রীতি নীতি কুরআন, সুন্নাহ, ইজমাহ এর পরিপন্থী হবে না, তা বিদয়াত না, বরং সুন্নাত। (মেরাত)।
প্রচলিত নিয়মে জশনে জুলুস ইদে মিলাদুন্নবি (দ.) পালন করা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা পরিপন্থী নয় যা উক্ত মুসলিম শরীফের হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত।
একশ্রেণির তথাকথিত আলেম ভুল তথ্য প্রচার করে সরল প্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে। তারা আরবি জশন শব্দের সঙ্গে উর্দু ‘মানানা‘ প্রত্যয় যুক্ত করে জশন শব্দের ভুল অর্থ নাচ, গান প্রভৃতি অর্থ গ্রহণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। রাসুলুল্লাহর সাহাবিগণের সুন্নাত আমলকে অগ্নি উপাসকদের বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে তুলনা করে হাদিস শরীফ অবমাননা করছে এবং নামাজে বিশৃংখলা, ফাসাদ সৃষ্টি করছে। (নাউজুবিল্লাহ)
তারা হয়ত কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝেনা, বিশুদ্ধ তাফসির গ্রন্থ অধ্যয়ন করে না। উসুলে তাফসির সম্পর্কে তাদের জ্ঞান শূন্য। তারা সুন্নাত ও বিদাত এর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেনা। তাই তারা এ পর্যন্ত কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা এর কোনো দলিল দিয়ে জশনে জুলুস ঈদে মিলাদুন্নবি (দ.) কে শরীয়ত বিরোধী, না জায়েজ কাজ প্রমাণ করতে পারে নি। শুধু মনগড়া বানীই তারা প্রচার করে এসেছে।
চার মাজহাবের ইমামগণের মূলনীতি হচ্ছে (আছলুল আশইয়ায়ে এবাহাতুন) প্রত্যক বস্তু মৌলিকভাবে জায়েজ। (শামী উসুলে বাজদাবি, নুরুল আনোয়ার)। অর্থাৎ প্রত্যক বস্তুর প্রাথমিক পর্যায় জায়েজ বা বৈধ। ইসলামি শরীয়তে না জায়েজ, হারাম, মাকরুহ প্রভৃতি বিধানগুলো বলে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ এগুলোর জন্য কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দলিল প্রয়াজন হবে। সুতরাং যে আমলের ক্ষেত্রে শরীয়তে নিষেধ করেনি তা সাধারণভাবে জায়েজ বা মুবাহ।
তাছাড়া নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মিলাদ নিজেই উদযাপন করেছেন। হযরত কাতাদাহ (র) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সোমবার রোজা পালন করতেন, তাকেঁ রোজা পালনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, রাসুলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (ফিহী উলিও ওয়া ফিহী উনজিলা আলাইয়্যাহ) সোমবার দিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি আর এই দিনেই আমার প্রতি কুরআন নাজিল শুরু হয়। (সহীহ মুসলিম ও তিরমিজি)।
১২ রাবিউল আউয়াল দিনের কোনো একসময় রাসুল া মসজিদে নববীতে আরোহন করলেন, সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, হে সাহবীরা বল। আমি কে? সকল সাহাবী উত্তরে বলেন, আপনি আল্লাহর রাসুল (দ.)। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই উত্তর দেয়া শুরু করলেন, আমি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আমি আব্দুল্লাহর পুত্র, আব্দুল মুত্তালিবের প্রৌপুত্র। আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান আরবের মক্কায়, সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্র কুরাইশের শ্রেষ্ঠ বংশ হাশেমীতে জন্মগ্রহণ করেছি। (মিশকাত শরীফ, ফজিলতে সাইয়্যিদিল মুরসালিন অধ্যায়)
এতে নবি মুহাম্মদ (দ.) সাহাবিদেরকে উদ্দেশ্যে নিজের গুনাগুন, নিজের বংশ গৌরবের বর্ণনা করার মাধ্যমে মূলত নিজেই নিজের মিলাদ পালন করেছেন। পরবর্তীতে সাহাবীগণ, সকল ইমামগণ উদযাপন করেছেন। এটি একটি অত্যন্ত বরকতময় আমল। এই আমল যুগ বিবর্তনে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপন হয়ে এসেছে। এই আমলকে না জায়েজ, বেদয়াত বলার কোনো সুযোগ নাই। এটা সুন্নাত আমল। বরং সুন্নাতে ইলাহী, সুন্নাতে নবি, সুন্নাতে সাহাবি।
সর্বোপরি ইসলামি শরীরয়তে জশনে জুলুস ইদে মিলাদুন্নবি (দ.) উদযাপন করা উত্তম আমল। বাংলাদেশের মতো অনেক মুসলিম দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি পালন করে হয়। যেমন– মিশর, লেবানন, মালেশিয়া, সুদান, আরবদেশ, ইয়েমেনসহ প্রভৃতি দেশ। তাছাড়া সমগ্র বিশ্বে মুসলমানরা নিজ উদ্যোগে এটি পালন করে। তাই আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে প্রিয় নবির আগমনে খুুশি উদযাপন করি এবং আল্লাহ ও তারঁ প্রিয় রসুলের সন্তুষ্টি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করু্ল্ল্ল্লন। আমিন।
লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা