জল–জোছনার শহরের চৈতন্যগলি কবে থেকে কবরস্থানে পরিণত হলো, অন্যভাবে বললে, চৈতন্যগলি কখন থেকে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; এখন আর কেউ জানে না। জনবসতি গড়ে উঠার আগে ওই স্থানটি ছিল ঝোপ–জঙ্গলে আর্কীণ একটি পাহাড়। পাহাড়ের চারপাশের অধিবাসীরা, যাদের নিজস্ব পারিবারিক কবরস্থান ছিল না, তারা লাশ দাফন করত। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে ব্রিটিশরা পাহাড় কেটে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর স্থাপনের উদ্যোগ নিলে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রতিবাদ করে। তারা এটিকে কবরস্থান বলে দাবি করে রেলওয়ের সদর দফতর স্থাপনে বাধা দেন। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তদন্তের প্রাকমুহূর্তে প্রতিবাদীরা রাতা–রাতি বেশ কিছু কৃত্রিম কবর নির্মাণ করে রাখে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রেলওয়ের সদর দফতর অন্যত্র করে। সেদিনের সেই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আবদুল লতিফ দোভাষ, আবদুল হক দোভাষ, রফিক উদ্দিন সিদ্দিকী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চৈতন্যগলির পাহাড়টি কবরস্থান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং প্রথমবারের মতো সংস্কার করে। সংস্কারোত্তর সময়ে ১৯২৬ সালে চৈতন্যগলিতে প্রথম কবর দেওয়া হয় আবদুর রহমান দোভাষকে। তাঁকে পূর্বনির্মিত কৃত্রিম কবরের একটিতে কবর দেওয়া হয়। গত শতকের আশির দশকে সিরাজুল হক মিয়ার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ২২ মহল্লার সর্দ্দারা আবার চৈতন্যগলির কবরস্থান সংস্কার করেন। এ–সময় স্থান সংকুলানের জন্যে সর্বসম্মতভাবে প্রথম কবর হিসেবে আবদুর রহমান দোভাষের কবরটা রেখে অন্যসব কবর ভেঙ্গে ২২ মহল্লার জন্য সম্পূর্ণ কবরস্থানকে ২২ ভাগে বিভক্ত করেন। বর্তমানে ২২ মহল্লার নেতৃবৃন্দ চৈতন্যগলি কবরস্থান তদারক করেন। ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’–এর জন্য বিশেষ অনুমতি রয়েছে। এখানে কবর দিতে হলে মৃতের আত্মীয়–স্বজনকে মহল্লা প্রধানের অনুমতি নিতে হয়। কবর খননের জন্যে নির্দিষ্ট কয়েকজন খনক আছে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আবদুল লতিফ দোভাষ, আবদুল হক দোভাষ, রফিক উদ্দিন সিদ্দিকী, সিরাজুল হক মিয়া, এম.এ.হান্নান প্রমুখকে এখানে কবর দেওয়া হয়েছে। এটি চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ কবরস্থান।
দামপাড়াতে ছিল কুন্ডুবাবুদের বিশাল চা বাগান। এর কিছু অংশ আবাদ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে–আগে পুলিশ স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়, আজ যাকিনা ‘দামপাড়া পুলিশ লাইন’ নামে পরিচিত। পুলিশ লাইন তৈরির সময় ওই–স্থানে অনেক মানুষের কংকাল পাওয়া যায়। এই কংকালসমূহ ব্রিটিশ সরকার কুন্ডুবাবুদের অনুমতিক্রমে বর্তমান গরিবুল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন স্থানে দাফন করে। ক্রমে স্থানটি কবরস্থানে পরিণত হয়। এর অনেক পরে গরিবুল্লাহ শাহ মাজার স্থাপিত হয়। কথিত আছে, কুন্ডুবাবুরা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ‘গরিবুল্লাহ শাহ মাজার’ প্রতিষ্ঠার জন্য এ–স্থান দান করেন। বর্তমানে কবরস্থান সংরক্ষণের জন্য রয়েছে একটি কমিটি। সর্ব–প্রথম কার মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। যেহেতু এখানে কোনো স্থায়ী কবর নেই, তাই প্রাচীন কবরেরও সন্ধান পাইনি। স্থাপনকাল থেকেই দামপাড়ার আশে–পাশের লোকজনদের এখানে কবর দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দাফনের আগে কবরস্থান সংরক্ষণ কমিটিকে অবহিত করতে হয়। গর্ভনর জাকির হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম বীরউত্তম প্রমুখ অনেক বিশিষ্টজনের কবর এখানে রয়েছে।
গরীবুল্লাহ শাহ’র মাজার সংলগ্ন উত্তর দিকে মেমন সম্প্রদায়ের (মেমনরা বেশিরভাগ সুন্নি ইসলামের হানাফি ফিকাহ মাজাফ অনুসরণ করে। ভারতের গুজরাট এবং পাকিস্তানের সিন্ধুতে তাদের অবস্থান বেশি।) একটি কবরস্থান আছে।
চট্টগ্রাম কলেজ রোডে রয়েছে হযরত মিসমিন শাহের(র.) দরগাহ, মসজিদ ও কবরস্থান। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ভল্যুম–২১, ডিসেম্বর ১৯৮৬ সংখ্যায় উল্লেখ আছে, ১৬৯১–৯২ সালে মোগল সম্রাট বাদশাহ আলমগীর বা আরঙ্গজেবের শাহি ফরমান মূলে হযরত মিসকিন শাহ(র.) এই ভূ সম্পত্তির মালিক হন। হযরত মিসকিন শাহ(র.)-এর মৃত্যুর পর এখানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। তখন থেকেই হযরত মিসমিন শাহের(র.) মাজার ও মসজিদ সংলগ্নস্থানটি কবরস্থানে পরিণত হয়। আলহাজ্ব আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষরা খাদেম হিসাবে প্রথম দিকে এর দেখাশুনা করতেন। পরবর্তীকালে তিনি এই স্থানটিকে ওয়াকফ করে নিজে মতোয়াল্লি নিযুক্ত হন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ কামালউদ্দিন খাঁন একসময় মতোয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে দৈনিক আজাদীর ৩৫ বৎসর পূর্তিতে বিশেষ সংকলন তৈরির সময়ে ‘মৃতের দাফন ও সৎকার’ বিষয়ক প্রতিবেদন তৈরি করতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সে–সময় (১৯৯৫ সালে) এখানে পুরানো কবরের মধ্যে ১৯২৫ সালের একটি কবর তিনি দেখিয়েছিলেন।
বর্তমানে চন্দনপুরার আশেপাশের অধিবাসীদের লাশ এখানে কবর দেওয় হয়। এখানে কবর দিতে হলে মতোয়াল্লির অনুমতি নিতে হয়। খান বাহাদুর ফজলুল কাদের, খান বাহাদুর মকবুল হোসেন, মোহাম্মদ সফদর হোসেন, আবুল খায়ের সিদ্দিকী এম.পি, বিচারপতি মুহাম্মদ আলী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বখতেয়ার, আবু ছৈয়দ দোভাষসহ অনেক বিশিষ্টজনের কবর এখানে আছে।
ষোলশহর দু’নম্বর গেট, কদম মোবারক এতিমখানা, আগ্রাবাদ ইত্যাদি এলাকায়ও ছোট–ছোট কবরস্থান আছে। এছাড়াও রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম হত্যাকান্ডের পর অনেক শহিদকে পাথরঘাটা বান্ডেল রোডের একটি কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়।
জল–জোছনার শহরে খ্রিস্টানদের কবরস্থান আছে। তাদের যে–ছয়টি ধর্মপ্রদেশে বাংলাদেশ বিভক্ত, এর একটি চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৫৯৮ সালে ফাদার ফ্রেন্সিস ফার্নানডেজ প্রথম ক্যাথলিক খ্রিস্ট্রান পুরোহিত হিসাবে ভারতের কোচিন থেকে চট্টগ্রাম আসেন। তিনি ১৬০২ সালের ১৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। বন্দীদশায় মৃত্যু হলে তাঁকে আনোয়ারার দেয়াং–এ কবর দেওয়া হয়। ‘মরিয়ম আশ্রম’ নামে পরিচিত এ–স্থানটি ছিল খ্রিস্টানদের প্রথম কবরস্থান। পরবর্তীকালে কার্যক্রম পাথরঘাটা ‘জপমালা মা মারিয়া ধর্মপল্লী’তে স্থানান্তরিত হলে এখানেই নতুন কবরস্থান নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে দেয়াং–এ আর কবর দেওয়া হয় না। পাথরঘাটা বসতি স্থাপনের কোনো সন–তারিখ এখন আর সংরক্ষণে নেই। পাথরঘাটা কবরস্থানের শুরুর ইতিহাসও তাই জানা যায়নি। এখন এখানে ‘আমেরিয়া ফ্রেইটাস’ নামে একজন মহিলার কবর পুরানো হিসাবে সংরক্ষিত আছে। তিনি ১৮৪৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। কবরস্থানের প্রবেশ পথের ডানদিকে আছে, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম হত্যাকান্ডে শহিদ যুবনেতা এথেল বার্ড গোমেজ (কিশোর)-এর কবর। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে রক্ষিত তাঁর সমাধিফলকে লেখা আছে, ‘আত্মার শান্তি হোক’। এখানকার শতাব্দীর প্রাচীন স্মৃতিসৌধসমূহের স্থাপত্য সৌন্দর্য অপূর্ব। পাথরঘাটা ‘জপমালা মা মারিয়া ধর্মপল্লী’র সদস্যদের এখানে কবর দেওয়া হয়। সদস্যভুক্ত পরিবারের কারো মৃত্যু হলে প্রথমে পুরোহিতকে অবহিত করা হয়। পুরোহিতের নির্দেশে চার্চের সুউচ্চ মিনারে স্থাপিত ঘন্টাধ্বনি ধীর লয়ে বাজানো হয়। এ–সময় খবরটা কবর কমিটিকে জানানো হয়। অবশ্য ঘন্টার–ধ্বনি শুনে অনেকে আসেন। কমিটির তত্ত্বাবধানে কবর খনন হয়। এরপর মৃতদেহ কবরস্থানে আনলে একটি প্রার্থনা সভা হয়। যে সুসজ্জিত কফিনে লাশ আনা হয়, ওটি সরবরাহ করে ‘সাধু ভিনসেন্ট পল’ (S.V.P) নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ফাদার, ব্রাদার ও সাধারণের জন্য রয়েছে পৃথক–পৃথক স্থান। সিস্টারদের কবর দেওয়া হয় সম্পূর্ণ ভিন্নস্থানে। তাঁদের কোনো কোনো কবর তিনতলা বিশিষ্ট হয়। প্রথম থেকেই ব্যবস্থা থাকে, যাতে একইস্থানে তিনজনকে কবর দেওয়া যায়। এ কবরস্থানটি পাথরঘাটা সিস্টারদের বাসার পূর্বদিকে অবস্থিত।
জামালখানে ক্যাথলিকদের ‘নির্মলা মারিয়ার ধর্মপল্লী’ নামে আরেকটি কবরস্থান আছে। এটা প্রথমদিকে পাথরঘাটা ‘জপমালা মা মারিয়া ধর্মপল্লী’র নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ১৯৫৮ সালে জামালখানে পৃথক চার্চ প্রতিষ্ঠিত হলে কবরস্থানের তত্ত্বাবধান এ–চার্চের কাছে আসে। এখানেও আছে অনেকদিনের পুরনো অনেক কবর। সবচেয়ে পুরাতন কবরটি উনবিংশ শতাব্দির পঞ্চাশের দশকের। এ–কবরস্থানটির অনেক এপিটাফ খুবই প্রশংসিত। ড. মুনতাসির মামুন ‘এপিটাফ’ বইতে এ–কবরস্থানের এপিটাফের খুব প্রশংসা করেছেন। এখানে কবর খনন করা হয় স্বেচ্ছাশ্রমেরভিত্তিতে। ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারকে কবর এখানে দেওয়া হয় না।
প্রোটেস্ট্যান্ট ও ব্যাপটিস্টদের জন্য বিবিরহাটে পৃথক কবরস্থান আছে। এটি ১৭৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ক্ষয়ক্ষতির কারণে পুরানো অনেক কবর নষ্ট হয়ে যায়। ১৮৫৪ সালের ব্রিটিশ নাগরিকের কবর এখানে পুরনো কবর হিসেবে সংরক্ষিত আছে। এর আগেও এখানে কবর দেওয়া হতো। এ–কবরস্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত অনেক ব্রিটিশ সৈনিকের কবর ছিল। পরবর্তীকালে এগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহিদদের স্মৃতিবিজরিত ‘ওয়ার সিমিট্রি’তে স্থানান্তরিত হয়। বিবিরহাটের কবরস্থানের জন্য পৃথক কমিটিও আছে। এখানে কবর দিতে এ–কমিটির অনুমতি লাগে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার