অভয়মিত্র শ্মশান আমার জল–জোছনার শহর চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের সব চেয়ে বড় মহাশ্মশান। বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, আমি সে–দিনের আগে অভয়মিত্র শ্মশানে কখনও যাইনি। অভয়মিত্র শ্মশান প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০১ বছর পর এখানে সেদিন গিয়েছিলাম। রায়বাহাদুর অভয়াচরণ মিত্র ১৮৯৩ সালে (১৩০০বঙ্গাব্দ) এই মহাশ্মশান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালের ২৩ এপ্রিল অভয়চরণ মিত্র এবং পার্বতী সুহৃদমাতা ১৯২৭ সালে (১৩৫৫ বঙ্গাব্দের ৫ চৈত্র) মৃত্যুবরণ করলে মহাশ্মশানের নামকরণ করা হয় ‘পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশান’। পরবর্তীকালে রায়বাহাদুর অভয়াচরণ মিত্রের সমাধি সৌধে অভয়ানন্দ শিব স্থাপন করা হয়।
মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আগেও অভয়মিত্র শ্মশানের সংস্কার হয়েছে। প্রথমদিকে সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন পৌর ভাইস চেয়ারম্যান জে.সি.গুহ, সুরেশ বানার্জী, মনমোহন বিশ্বাস, মনীন্দ্রলাল সরকার, সুরেন্দ্রচন্দ্র পালিত, কালাচরণ চক্রবর্তী, যতীন্দ্রলাল রক্ষিত প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই মহাশ্মশানের উন্নয়নের জন্যে আমার জল–জোছনার শহর চট্টগ্রামের জলদাস সম্প্রদায়েরও রয়েছে অনেক অর্থ–শ্রম। এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৫৮ সাল (১৩৬৪ বঙ্গাব্দের ১০ পৌষ) থেকে এখানে মহোৎসব অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
‘পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশান’র বর্তমান প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’। এই মহাশ্মশানের সার্বিক উন্নয়নে ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ নিয়মিত অর্থায়ন করে থাকে। এখানকার ডোম, চন্ডাল, পুরোহিত ও দারোয়ানের বেতন ভাতা প্রদান করে। সাবেক পৌরপ্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মফিজুর রহমান চৌধুরীর উদ্যোগে ইংল্যান্ড থেকে বৈদ্যুতিক চুল্লী এনে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্রম শুরুর আগে দেশে ঘটে যায় ১৯৯০ সাল ও ১৯৯২ সালের তান্ডব। সে–সময়ের সাম্প্রদায়িক হামলার পর বৈদ্যুতিক চুল্লীটি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। ফলে আবার কাঠের চুল্লীতে মৃতদেহ দাহ করা শুরু হয়। এখানে শিশুদের সমাধির জন্য পৃথক জায়গা আছে।
পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশানে কোনো মৃতদেহ দাহের আগে ওখানে রক্ষিত ডেড–বুকে মৃত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হয়। তবে এর জন্য কোনো প্রকার অর্থ প্রদান করতে হয় না। এখানে নির্ধারিত কাঠের চুল্লীব্যতিত বাইরে স্থায়ী শ্মশান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাহ করতে হলে মহাশ্মশান মহোৎসব ও কার্যকরী কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুমতি নিতে হবে। ১৯১০ সালের ১০ মার্চ মৃত্যুবরণকারী রামবক্স সিংহ মোক্তারের শ্মশানটি সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে এখানে সংরক্ষিত থাকতে তখন দেখেছি। এছাড়াও গত শতকের দ্বিতীয় দশকের অনেক শ্মশানও দেখেছি। কয়েকটা নাম এখনও মনে আছে। নামগুলো হলো– অধ্যক্ষ বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্য, ডা. পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, যতীন্দ্রমোহন রক্ষিত, অপর্ণাচরণ কানুনগো, মনোমোহন বিশ্বাস প্রমুখ।
পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শবও দাহ করা হয়। সে–সময় দাহের কাজ তদারকি করেন বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই মহাশ্মশানে চীনা, থাই নাগরিককে দাহ করা হয়েছে বলে শুনেছি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বেওয়ারিশ লাশ সৎকার এখানে হয়। প্রথম দিকে বেওয়ারিশ লাশ চুক্তিভিত্তিতে সৎকার করতেন হাজরী গলির যোগেশ আচার্য। আমাদের সময়ে এ দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি অগ্রণী সংঘের সাদারণ সম্পাদক অমৃতাংকুর সেন (হারু বাবু)। হারুদার মুখে শুনেছি, তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন ১৯৭৪ সাল থেকে। তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান ফজল করিমের বিশেষ অনুরোধে অগ্রণী সংঘ এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সাল অবধি অগ্রণী সংঘ বিনা অর্থে এ দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অগ্রণী সংঘকে প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশ সৎকার করে ৮০ টাকা করে দিত। ১৯৯৫ সালেও সেই ৮০ টাকা করে দিতে শুনেছি। সে–সময়ে প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশ সৎকার করতে প্রায় ৫০০ টাকা অগ্রণী সংঘের খরচ হয়েছে। বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে আমার জল–জোছনার শহরে চট্টগ্রামের মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথমে সিটি কর্পোরশনের স্বাস্থ্য বিভাগকে জানায়; সিটি কর্পোরশন অগ্রণী সংঘ অর্থাৎ হারুদাকে জানায়। তারপর হারুদা সংকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তখন হারুদার মধ্যে একটা হতাশার সুর দেখেছিলাম। এ হতাশা শব সৎকারের জন্য ছিল না। তাঁর হতাশা ছিল, এ–সব লাশ বহনের জন্যে কোনো যানবাহন নেই। বাঁশের খাটিয়া করেই অনেক সময় অনেক দিনের পচা ও গলা লাশ বহন করতে হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আমার জল–জোছনার শহরে চট্টগ্রামে যে গণহত্যা হয়েছিল, সে কথা পাঠক মহলের নিশ্চয় জানা থাকার কথা। পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশান ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম গণহত্যার পর ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করে। এ শ্মশানের কালু ডোমের নাম তখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে যায়। আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বহ্নিতে (সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী) প্রয়াত শিল্পী সাখাওয়াত খান কালু ডোমকে নিয়ে একটা অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন। কালু ডোম ১৯৯০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মারা যান। তৎকালিন পুলিশ–বিডিআর কালু ডোমকে অস্ত্রের মুখে, কারো কারো মতে, অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়ে পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশানে ২৪ জানুয়ারি’র গণহত্যার অসংখ্য লাশ দাহ করিয়েছিল। সে লাশ হিন্দু–মুসলিম–খৃস্টান–বৌদ্ধ কি না কোনো ধরনের বাচবিচার করেনি। এসব অমানবিক কাহিনী পত্রিকান্তরে প্রকাশের পর অনেকে কালু ডোমকে দেখতেও গিয়েছিল।
পার্বতী সুহৃদ অভয়মিত্র শ্মশান আমার জল–জোছনার শহর চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান শ্মশান হলেও গোল পাহাড়ে আছে আরও একটি শ্মশান। এ–জায়গার মালিক ছিলেন আমাদের বোয়ালখালী থানার হাওলা গ্রামের সারদা লালা। এটা পাহাড় ছিল বলে এখানে বিক্ষিপ্তভাবে এখানে–ওখানে দাহ করা হতো। কোনো স্থায়ী শ্মশান ছিল না। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এ পাহাড়ের চার পাশে জনবসতি গড়ে উঠলে গোল পাহাড় শ্মশানে দাহ করা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে সাধু–মহাপুরুষদের সমাধি দেওয়া হয়। আমাদের সময়ে আরও শুনেছি, গোল পাহাড় শ্মশানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সমাধি দেওয়া হতো। এছাড়া গোসাইলডেঙ্গা কালী বাড়ি, কাটগর শিল্প এলাকা এবং স্টিল মিল বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের আরও তিনটি শ্মশান আছে বলে জেনেছি। আমার জল–জোছনার শহর চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও এবং পাঠানটুলি আউটার সিগন্যালে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুটি শ্মশান আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংসার অনুষ্ঠান অপূর্ব সুন্দর ও জাঁকজমক পূর্ণ হতে দেখেছি। শিখ সম্প্রদায়ের একটি মন্দির থাকলেও তাদের পৃথক কোনো শ্মশান নেই। জল–জোছনার শহর চট্টগ্রামের মুসলমানদের কবর ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সমাধির কথা পরবর্তী লেখায় উল্লেখ করব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার