চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার বিষয়টি সরকারিভাবে প্রথম চিহ্নিত করা হয় ১৮৫৬ সালে। এরপর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমস্যা। কয়েক দশক ধরে যা স্থায়ী সমস্যায় রূপ নিয়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, অল্প বৃষ্টি হলেই প্রকট হয় জলাবদ্ধতা। তবে আশার কথা হলো, জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে চলমান ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ১৬৬ বছরের পুরনো সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য মেগা প্রকল্পটি ছাড়াও জলাবদ্ধতা নিরসনে আরো তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে। সবগুলো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৫৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সংশোধিত হয়ে মেগা প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রকল্পটির সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) অনুমোদন হলে জলাবদ্ধতাজনিত সমস্যা নিরসনে চারটি প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
মেগা প্রকল্পে আশার আলো : জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর মেগা প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী।
২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সাথে সিডিএর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। পরে নানা প্রক্রিয়া শেষে একই বছরের ২৮ এপ্রিল নগরের চশমা খাল ছাড়াও মুরাদপুর এলাকার সুন্নিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন খাল ও বহদ্দারহাট মোড়ের বড় নালা পরিষ্কার করার মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতাভুক্ত খাল ৩৬টি হলেও পাঁচটি খালে পাম্পসহ রেগুলেটর স্থাপন হবে। খালগুলো হচ্ছে মহেশ খাল, টেকপাড়া খাল, কলাবাগিচা খাল, ফিরিঙ্গিবাজার খাল ও মরিয়ম বিবি খাল। মহেশখাল ছাড়া বাকিগুলোতে রেগুলেটর বসানো হয়েছে। এর ফলে বৃষ্টি ছাড়া জোয়ারের পানির কারণে যে জলাবদ্ধতা সমস্যা হয় তা দূর হবে।
মেগা প্রকল্পটিতে ১০৭ দশমিক ৭ একর জমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ৭২৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণে ৩১৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া ৩৬টি খালের মাটি অপসারণে ২৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, মাটি খননে ২৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ১৭৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা, ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপনে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা, বন্যার পানি সংরক্ষণে তিনটি জলাধার স্থাপনে ৪৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ছয়টি আরসিসি কালভার্ট প্রতিস্থাপনে ৭ কোটি ২০ লাখ, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণে ৮৪ কোটি ৭৫ লাখ, ১২টি পাম্প স্থাপনে ৩২ কোটি ৬ লাখ, ৪২টি সিল্ট ট্রাপ স্থাপনে ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার নতুন সাইড ড্রেন নির্মাণে ১৭ কোটি টাকা ২২ লাখ টাকা ও ২০০টি ক্রস ড্রেন কালভার্ট নির্মাণে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে প্রকল্পে।
প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী আজাদীকে বলেন, ৯৫ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পে যত ব্রিজ-কালভার্ট ছিল সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে শহরের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে মেগা প্রকল্প নিয়ে সরকারের একটি নিবিড় পরীবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোজনিত সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সমস্যা চট্টগ্রাম শহরে জনজীবনে ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, রাস্তায় যানজট সমস্যা তৈরি করে এবং বিদেশি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিতকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত ক্ষতি সাধন করছে। শহরের পরিকল্পিত উন্নয়নে ১৯৯৫ সালে সিডিএ এক মাস্টার প্ল্যান-১৯৯৫ তৈরি করে, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু ২৫ বছরেও উক্ত মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমানে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশসহ অধিকাংশ রাস্তাঘাট কোমর হতে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। সাগরে জোয়ারের সময় শহরের নিম্নাঞ্চল নিয়মিত প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
এতে জনজীবনে ব্যাপক দুর্ভোগ নেমে আসে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটে। এ সমস্যা হতে চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা করা ও ভবিষ্যতে শহর সম্প্রসারণের বিষয় বিবেচনা করে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান-১৯৯৫ এবং এর আলোকে ওয়াসা কর্তৃক প্রণীত আপডেট ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সিডিএ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
আরো তিন প্রকল্প : মেগা প্রকল্পের বাইরে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর আরো একটি প্রকল্প আছে। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। ১৬ আগস্ট একনেক সভায় ৪৩৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় চাক্তাইসহ ১২ খালের মুখে পাম্প হাউজসহ স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন পায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৭ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ৬৯টি পাম্পসহ ২৩টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করার কথা। বর্তমানে ১০টি খালে স্লুইচ গেট নির্মাণ কাজ চলছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান-১৯৯৫ এর সুপারিশের আলোকে নতুন একটি খাল খনন প্রকল্পেরও কাজ চলছে। ২০১৪ সালের ২৪ জুন ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় অনুমোদন হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্পটি। তিন দফা সংশোধনের পর বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়।
বাড়ইপাড়া খালটি নগরের বাড়ইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ আমানত রোড হয়ে নূর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলিরহাটের পাশে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে। খালটির দৈর্ঘ্য হবে আনুমানিক ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৬৫ ফুট। খালটির মাটি উত্তোলন, সংস্কার ও নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে খালের উভয় পাশে ২০ ফুট করে দুটি রাস্তা নির্মাণ করা হবে। নতুন খাল খনন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে এবং নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টির ফলে জনগণের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে বলে মনে করেন চসিকের প্রকৌশলীরা।