নগরের ১৩ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রত্যক্ষভাবে জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে আছে। পরোক্ষভাবে ঝুঁকিতে আছে ৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। প্রত্যক্ষভাবে ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ২২টি ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ছয়টি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে, তিনটি অত্যন্ত ঝুঁকিতে এবং বাকি ১৩টি ওয়ার্ড নিম্ন থেকে মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে। জলাবদ্ধতা সমস্যার অতি দ্রুত সমাধান না করলে ভবিষ্যতে দৈনিক ২০০ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও শহরের বেশিরভাগ নিচু এলাকা ১ দশমিক ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।
চসিকের প্রণীত ‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ তথা চট্টগ্রাম মহানগরীর আপদকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সিলড্রেন ও ইপসা কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়নে সহযোগিতা করে। এতে জলাবদ্ধতার কারণ ও জলাবদ্ধতার প্রভাবে নগরবাসীর স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিগুলোও তুলে ধরা হয়। কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ শাহ জালাল মিশুক। তিনি আজাদীকে বলেন, রোববার (আজ) কর্মপরিকল্পনাটি উপস্থাপন করা হবে। জলাবদ্ধতার ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ আছে কর্মপরিকল্পনায়।
ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯ শতাংশ জনসংখ্যা : কর্মপরিকল্পনায় জলাবদ্ধতার ফলে দশটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে গুরুতরভাবে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৯ শতাংশ।
কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, জলাবদ্ধতার ফলে ১৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়। এতে ব্যাহত হয় শিক্ষা কার্যক্রম। হাসপাতাল প্লাবিত হওয়ায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত সবাইকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় জলাবদ্ধতার কারণে। এছাড়া জলাবদ্ধতার ফলে শহরের আবাসিক কাঠামোর এক ষষ্ঠাংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরের ৪৭ শতাংশ রাস্তা ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ হাজার গুদামসহ খাতুনগঞ্জের প্রধান সড়কের উভয় পাশে ২২৪টি স্থাপনা জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
জলাবদ্ধতার প্রভাবে বিভিন্ন ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের পরিবহনের জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয়। ফলে বৈদ্যুতিক শক বা শর্ট সার্কিট দ্বারা মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে এবং পানি সংক্রান্ত রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ ৫৮ স্থান : কর্মপরিকল্পনায় তথ্য অনুযায়ী, শহরের ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ এলাকাজুড়ে থাকা ২২টি ওয়ার্ডের মোট ৫৮টি স্থানকে জলাবদ্ধতা প্রভাবিত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মোহরা, পূর্ব ষোলশহর, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, ফিরিঙ্গি বাজার ও বক্সিরহাট ওয়ার্ডকে অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং চান্দগাঁও, চকবাজার ও পাথরঘাটা ওয়ার্ডকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড বলা হয়।
কর্মপরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর বর্ষায় শহরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়। পতেঙ্গা, হালিশহর, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, দেওয়ানহাট, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, চকবাজার, মুরাদপুর, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, শুলকবাহার, ষোলশহর, নাসিরাবাদ ও প্রবর্তক মোড় এলাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধতার কারণে তীব্র ভোগান্তিতে পড়েন।
দিনে গড়ে ১২৫ মিমি বৃষ্টিপাত হলেও শহরের প্রধান সড়কের উপর প্রায় ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট প্লাবিত হয়। ভারী বৃষ্টিপাতের সময় এই অঞ্চলগুলোতে বেশিরভাগ ১ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত গভীর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য (৪-৫ দিন বা তারও বেশি) সময় ধরে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো ৩-৫ ফুটের পানির নিচে প্লাবিত হয়।
জলাবদ্ধতার চিহ্নিত কারণ : জলাবদ্ধতার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খালের মুখে অনুপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও স্লুইচ গেট না থাকা। অবৈধ দখল এবং কঠিন বর্জ্য জমার কারণে খালগুলোতে বর্জ্য এবং বৃষ্টির পানি চলাচল করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাশয় ও খাল অতিরিক্ত দখল। পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা, সরু পয়ঃনালী, অপরিকল্পিত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ন।
সুপারিশ : জলাবদ্ধতার ঝুঁকি কমাতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সিডিএ প্রণীত ১৯৬৯ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ মহাপরিকল্পনার আলোকে নগরীর সকল খাল আরএস সিট অনুযায়ী জরিপ করে উদ্ধার করা। মৌজাভিত্তিক নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় ও জলাভূমিকে অতি দ্রুত যথাযথভাবে চিহ্নিত করা। ড্রেনের উপর স্ল্যাব দেয়া, ড্রেন সংস্কার ও উঁচুকরণ এবং ড্রেনের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। খাল ও ড্রেনগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সকল উন্নয়ন প্রকল্পে নিষ্কাশন বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেয়া। ভবন নির্মাণের সময় বাধ্যতামূলক অনাচ্ছাদিত স্থান সংরক্ষণ করার জন্য মহাপরিকল্পনায় প্রস্তাবিত নির্দেশনা দেয়া, যা সঠিকভাবে প্রতিপালন করলে বৃষ্টির সময় ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর চাপ কমবে এবং জলাবদ্ধতা কমাতে ভূমিকা রাখবে।