চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে চলমান চারটি প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতন করার ওপর জোর দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। একইসঙ্গে তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্টদের ‘প্রাতিষ্ঠানিক ইগো’ দূর করে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এমনকি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। নদীতে ৬ থেকে ৭ মিটার পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক ইত্যাদি দিয়ে জমাট বেঁধে গেছে। এসব বর্জ্য তো সিটি কর্পোরেশন ফেলে নাই। আমি, তুমি বা আমরা ফেলেছি। এই জায়গায় জনগণকে সচেতন করতে হবে, যেন বর্জ্যের প্রপারলি ম্যানেজেমেন্টের মধ্যে তারাও অংশীদার হয়।
গতকাল রোববার বিকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এলাকায় জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও চসিকের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। টাইগারপাস চসিক কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে পুরনো সমস্যা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বহু বছর ধরে এটা নিরসনের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার অগ্রগতি আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ছে না। বাস্তবে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কাজ করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলো উঠে আসছে সেগুলো কিভাবে সমাধান করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, পদে পদে সমন্বয়ের কিছুটা অভাবের কারণে এটা হচ্ছে। সেখানেও একটা ভালো সাজেশন আছে। সমস্ত মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত যে মিটিংগুলো করা দরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত মিটিংগুলো করা হয় সেটা যাতে আরো ত্বরান্বিত হয় এবং সুষ্ঠুভাবে হয়।
এর আগে সভায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামে চলমান চারটি প্রকল্প দ্রুত শেষ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান সম্ভব না। এজন্য প্রয়োজন জনগণের সহযোগিতা। জনগণকে সচেতন করতেও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
সভায় তিনি জলাবদ্ধতা নিরসন চট্টগ্রামের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে বলেন, চট্টগ্রামের সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি জড়িত। এজন্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংস্থাগুলোকে ইগো ত্যাগ করে জনস্বার্থে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
চসিকের নির্মিত রাস্তা কাটাকাটি প্রসঙ্গে : সাংবাদিকদের এ এফ হাসান আরিফ বলেন, একটা কমন অভিযোগ হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশন সুন্দর ও চকচকে রাস্তা তৈরি করল। কিছুদিন পর দেখা গেল খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ হয়ে গেছে। এখানেও সমন্বয়ের অভাব আছে। এখানে ইনডিভিজ্যুয়াল ইগো না, ইনস্টিটিউশনাল ইগো কাজ করে। এ জায়গায় সবাই যদি মনে করে, আই এম ডুয়িং জব ফর পাবলিক ফর দ্যা সিটিজেন। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা বা অন্যান্য আরো যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সবাই সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তা কাটাকাটি বা রক্ষণাবেক্ষণ করলে একই রাস্তা বছরে তিন–চারবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ করতে হবে না। এই টাকাটা উন্নয়নের জন্য ব্যয় করতে পারি।
মশক নিধনে গবেষণায় জোর : মশার কীটনাশক প্রয়োগে গবেষণায় জোর দেন এ এফ হাসান আরিফ। ‘মশক নিধনে কীটনাশক প্রয়োগে চসিকের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং ফগিং শিখতে বিদেশ সফর নিয়ে’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেটা হয়েছে সেটা আগে হয়েছে, বিগত এক মাসে হয়নি। সেটার জন্য ড. ইউনূসের বিপ্লবের সরকারকে দায়ী করা যাবে না। এখন আয়ুর্বেদিক কিছু কম্পোনেন্ট দিয়ে মশার ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেটা খুব ইফেক্টিভ।
তিনি বলেন, রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, যেটা বিদেশে এক নম্বর আইটেম, ওটা আমাদের এখানে একবারে শেষের দিকে আছে। সিটি কর্পোরেশনকে দোষ দিয়ে লাভ কি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে? আন্তর্জাতিক মানের কোনো থিসিস কি বের হচ্ছে? যেটা হয় সেটাও তো লজ্জাষ্কর বিষয়। না বলাই ভালো আর কি। সব জায়গাতেই আমাদের একটু অবক্ষয় হয়েছে। এটার দিকে কোনো সময় জোর দেওয়া হয়নি। রিসার্চ ছাড়া আমি আগাব কি করে। আমাদের এ জায়গায় খুব দুর্বল। সব জায়গায় আমি এটা ডেভেলপ করতে বলি, তাহলে ওষুধ নিয়ে আর কেলেঙ্কারি হবে না। শুধু ফগিং কিভাবে হয় সেটা দেখার জন্য সুইজারল্যান্ড যেতে হবে না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং কিউরেটিভ (নিরাময়) দুটো বিষয়। সিটি কর্পোরেশন প্রতিরোধ করে যাবে। সেটার রেজাল্ট পেতে একটু সময় লাগে। কিউরেটিভ যেটা সেগুলোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সিটি কর্পোরেশন থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মেইনলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে।
তিনি বলেন, কিউরেটিভের জায়গায় রোগীর পরিবারের কিছুটা গড়িমসি ভাব আছে। এটা আমাদের সামাজিক রোগ আর কি। বয়স্করা বলে জ্বর হলে তিন দিন দেখতে হয়, এমনি জ্বর হয়েছে। এগুলো কিন্তু আমাদের সমাজেরই কথা। যার কারণে তিন দিনের মাথায় যখন এগ্রেভেটেড হয়ে যায় তখন নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রাথমিকে হয়তো একজনের কাছে আসে, সে রেফার করে স্পেশালিস্টের কাছে। ফলে এক সপ্তাহ পর যখন আসে তখন দেখা যায় সে খুব ক্রিটিক্যাল হয়ে গেছে এবং অন্যান্য অর্গানগুলোতেও এফেক্ট করছে। ঢাকায় আমরা অ্যানালাইসিস করে দেখেছি, ক্রিটিক্যাল রোগের কারণে ডেঙ্গু রোগী মারা যাচ্ছে। কিন্তু আল্টিমেটলি যত দোষ নন্দ ঘোষ, ডেঙ্গুর ওপর আসছে। কিন্তু মেডিকেলের যে প্রটোকল বা গ্রামার অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, তার হয়তো কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে বা ট্রমা করেছে, হয়তো কারো কিডনি ফেইল করেছে। আমি যদি তাকে প্রথম স্টেজে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে পারি তখন এটা হতো না।
তিনি বলেন, এখানে মিডিয়ার ভূমিকা আছে। বলতে হবে, একটু জ্বর হলেই ডেঙ্গু স্পেশালিস্টের কাছে যেতে হবে। সিটি কর্পোরেশন থেকেও প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস দেওয়া হচ্ছে। মানুষ ডেঙ্গু টেস্টে অনেক টাকা–পয়সা লাগবে ভয় থেকে টেস্ট করাতে চায় না। সেখানে ফ্রি টেস্ট করানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে অন্যান্য জায়গায়ও টেস্টের ব্যবস্থা আছে। একটু জ্বর জ্বর লাগলে পুরনো মান্দাতা আমলের ধ্যান ধারণা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে টেস্ট করাতে সেন্টারে যেতে হবে।
সভায় কে কী বললেন : চসিক প্রশাসক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সম্পর্কে উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ, সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম, চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমাম হোসেন রানা, চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমি।
সভায় জানানো হয়, জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে চলমান কার্যক্রম সম্পর্কেও নানা তথ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৬২০ কোটি টাকার প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী শিবেন্দু খাস্তগীর এবং চসিকের বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের অগ্রগতি তুলে ধরেন চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম।
মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু থেকে জনগণকে বাঁচাতে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগকে ভূমিকা রাখতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত কিট এবং হঠাৎ করে রোগীর চাপ দেখা দিলে রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম ও ডা. মো. ইমাম হোসেন রানা জানান, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা। কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে রোগী বা রোগীর স্বজনরা যদি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নেন তাহলে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
কমান্ডার লতিফুল হক কাজমি বলেন, ৪১টি ওয়ার্ডে নিয়মমাফিক মশার ওষুধ ছিটানোর পরও দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ওয়ার্ডে মশা কমছে না। অথচ একই ওষুধে অন্যান্য এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে আছে। এতে ধারণা করছি বিদ্যমান ওষুধের প্রতি কিছু প্রজাতির মশার হয়তো প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার জীবনচক্রও বদলে যাচ্ছে। এজন্য মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় জানতে গবেষণা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরামর্শে ভেষজ মেডিসিন মস্কুবার ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া গেছে। এ ধরনের মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় খুঁজতে গবেষণা প্রয়োজন।
লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ভৌত কাজে ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড ২০১৮ সাল থেকে কাজ করছে। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের অগ্রগতি ৭১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫০ দশমিক ২২ শতাংশ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামান, চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিন, আইন কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী শাহীন–উল–ইসলাম ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি।