জলবায়ু সংকট উত্তরণে অর্থ যোগান

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশপ্ত আর্তনাদ পুরো বিশ্বকেই কঠিন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে অতিবৃষ্টিঅনাবৃষ্টিখরাবন্যাদাবদাহ ইত্যাদি সংকটে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব প্রচণ্ড অনুভূত। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের অধিকমাত্রায় শিল্পায়ননগরায়ইপরিবহনসহ নানামুখী উৎপাদন ব্যবস্থায় জ্বালানিসারকীটনাশককার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি ধরিত্রীর তাপমাত্রাকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে। সামগ্রিক পরিবর্তনজনিত দৃশ্যপট বর্তমানআগামী প্রজন্মের বসবাসযোগ্য পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে কোন অবস্থানে নিপতিত করছে তা এখনো যথার্থ অর্থে বোধগম্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবেলায় অনুন্নতউন্নয়নশীল বিশ্বের দেশজনগণ বিভিন্ন সমস্যায় বিপন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষুধাদারিদ্রমানবেতর জীবনপ্রবাহে এর গতিধারা খরস্রোতা নদীর মত সুস্থ জীবনযাপনে নদী ভাঙ্গনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলছে। নদীমাতৃক জনঅধ্যূষিত বাংলাদেশ বায়ুশব্দপরিবেশ দূষণে এর বৈরী দৃষ্টান্তের পরিচায়ক। কৃষিশিল্পআর্থ সামাজিক ব্যবস্থার পর্যুদস্ততা প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করছে। প্রায়োগিক কর্মকৌশল অবলম্বনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ উক্ত সমস্যাসমূহকে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।

উল্লেখ্য পটভূমিতে অতিসম্প্রতি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলনে ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট : স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মুখে ছয়টি প্রস্তাব পেশ করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন ছাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তহবিলকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার উদাত্ত আহ্বান ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পরামর্শগুলোর উপস্থাপনে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঠিক পথে রাখতে জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে হবে। এই বছরের শেষ নাগাদ আমাদের সকলকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে, বিশেষ করে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর ২০২৫ সাল পরবর্তী একটি নতুন জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে একমত হতে হবে। বিশ্বকে যুদ্ধসংঘাত, অবৈধ দখলদারি এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারীশিশুদের নির্মম হত্যাকান্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। জলবায়ু প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করতে অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান পর্যায় অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অভিযোজনে সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ইউরো প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কপ২৮ জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের ‘জলবায়ু বৈষম্য : ৯৯ শতাংশের গ্রহ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এক শতাংশ মানুষ ৬৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষের সমান কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। এই এক শতাংশ মানুষ বছরে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের সে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করতে লাগবে দেড় হাজার বছর। ধনী ব্যক্তিরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতজলবায়ু সহনশীল বাড়িতে বসবাস করলেও, তারা যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে তা অনেক মানুষের দুর্ভোগের কারণ। ২০১৯ সালে নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৫৯০ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড। উল্লেখ্য প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এক শতাংশ মানুষ যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে, তা থেকে উৎপাদিত তাপ ২০২২ এ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভুট্টা, যুক্তরাষ্ট্রের গম, বাংলাদেশের ধান ও চীনের সয়াবিনের মোট উৎপাদন ধ্বংস করতে সক্ষম। এছাড়াও দরিদ্রপ্রান্তিকক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীঅভিবাসীনারী ও শিশুরা যারা খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন বা ভঙ্গুর বাড়িতে বসবাস করে, তাদের কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের সঞ্চয়বীমা বা সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে তারা অন্যদের চেয়ে বন্যাখরাতাপদাহ ও দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আর্থিক ও শারীরিক ঝুঁকিতে থাকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কার্বন নিঃসরণ থেকে সৃষ্ট তীব্র গরমের কারণে সারা বিশ্বে মারা যেতে পারে ১০ লাখ অতিরিক্ত মানুষ।

দীর্ঘ দিন যাবৎ জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো এর ভয়ানক পরিণতি ভোগ করছে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীলদেশসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে প্রচন্ড লণ্ডভণ্ড। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আইপিসিসির গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহসহ যাবতীয় উন্নয়ন উদ্যোগ তথা দারিদ্র দূরীকরণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাষণ ও জনস্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় জর্জরিত গরীব ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো। বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ্যাকশন প্ল্যানএ জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়কে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাবে প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। পাঁচ দশকে উষ্ণ দিনের সংখ্যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রতিবছরে কূন্য দশমিক ৩৯৪ দিন এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে কূন্য দশমিক ১৫ দিন করে বেড়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর উষ্ণ দিনের সময়ও কূন্য দশমিক ৫০৭ দিন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত দুই দশক যাবৎ বজ্রপাত বাংলাদেশে নতুন দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে বজ্রপাত সম্পর্কিত গবেষণা অনুসারে বিশ্বের সর্বত্র বজ্রপাত সমহারে বাড়ছে না, তবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বজ্রপাতের ওপর উষ্ণায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। অর্থাৎ, সারা বিশ্বে না বাড়লেও দক্ষিণ এশিয়া বা ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনেক দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে ২০১৩২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৮ জন যাঁদের ৭২ শতাংশই কৃষক। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে এটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন প্ল্যাটফর্ম (বিসিডিপি)’ নামে একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে যার আকার প্রায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিবৃতিতে জানা যায়, এই উদ্যোগে আইএমএফসহ অন্য সংস্থাগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাংকএশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ নিশ্চয়তা এজেন্সি (এমআইজিএ), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), এজেন্সি ফ্র্যান্সাইস দ্য ডেভেলপমেন্ট (এএফডি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি), গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ), কোরিয়া সরকার এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেবে এডিবি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের জন্য বরাদ্দ করা ১৯০ কোটি ডলারের ৫৩ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নির্ধারিত ছিল। তাছাড়া ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে ৫৫০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার অর্ধেকই থাকছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়। উল্লেখ্য ৮০০ কোটি ডলারের মধ্যে আইএমএফের অংশ হচ্ছে ১৪০ কোটি, বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি, এআইআইবির ৪০ কোটি, কোরীয় সরকারের ৪ কোটিসহ অন্য সংস্থাসমূহের কমবেশি অর্থায়ন রয়েছে। মোদ্দাকথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরার্মশক্রমে অস্ত্র উৎপাদনবিক্রয় এবং এর অপব্যবহারে অসম অস্ত্র প্রতিযোগিতায় গণহত্যা পরিহার করে শান্তিময় বিশ্ব স্থাপনের লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের মনযোগ আকর্ষণ জরুরি। আগামী দিনের বিশ্ববাসীকে সুস্থনিরাপদ ও বসবাসযোগ্য জীবনপ্রবাহ নির্বাহে সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অর্থের যোগান ও বিতরণকে অধিকমাত্রায় প্রাধান্য দেওয়াই হচ্ছে যুগের জোরালো দাবি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভাষা শহীদদের স্মরণ