পর্ব–২
তটরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা এদিকের ঝাউগাছগুলো আকাশছোঁয়া। পিরামিডাকৃতি গাছগুলোর তীক্ষ্ম পাতার ফাঁকে ফাঁকে মেরিন ড্রাইভের ক্ষুদ্রাকৃতি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে বড্ড ধীরগতির মনে হচ্ছে মোটরগাড়িগুলোকে। কিন্তু সত্য হলো গতির তোড় দেখানোর জন্য এই রাস্তার মসৃণতার বিকল্প নেই। স্থল থেকে জলে ফের চোখ ফেরানো। এখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ অন্য। বোট সোজা রাখতেই বেগ পেতে হচ্ছে।
আরো বেশ খানিকটা সময় চলতেই দূরে দৃশ্যমান হলো গর্জন গাছের ঋজু বিশাল গুঁড়ি। গগনমার্গের আরো কাছাকাছি যাবার লোভ তাদের। এই মাঝসমুদ্র থেকেও তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণেই আলাদা করে চেনা যায়। যদিও দূরত্বের কারণে বিশাল কাণ্ডগুলোকে খানিকটা হ্রস্বই দেখাচ্ছে। নৌযানের তীক্ষ্ম নাক পানিতে ডুবিয়ে এগোচ্ছি আমরা। রান্নার ব্যবস্থা হলো বোটেই। চায়ের ফাঁকে ফাঁকে রান্না বসিয়ে দিল হান্নান ভাই। ডিম ভাজির গুরুদায়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। পেঁয়াজ–টমেটো মিশিয়ে প্রথম ডিম পাত্রে ঢালতেই বাড়ল দুলুনি। এই ভয়ানক দুলুনিতে একবার তাওয়া চুলা থেকে গড়িয়ে পড়ার দশা হলো। এবার দুলুনি বাড়ল আরো। সাথে বমনের ইচ্ছাও! সেটা দমাতেই এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। ঢেউগুলো খেলতে শুরু করেছে আমাদের জলযানকে নিয়ে। এক ঢেউয়ের মাথা থেকে পরক্ষণেই উঠে পড়ছি আরেক ঢেউয়ের মাথায়। টানা বেশ খানিকক্ষণ আমাদের সন্ত্রস্ত করে তবেই থামল দুলুনি।
সাগরের জলে অবশ্য নিরিখ করে দেখার মতো কিছুই নেই তেমন। আদিগন্তবিস্তৃত নোনাজল আর নোনাজল। দুনিয়া এখনো এখানে আদিম। দিকচক্রবালে চোখ পড়লে মনে হয় নোনাজল যেন ছুঁয়েছে আসমান। মানুষ যতই স্থল শাসন করুক না কেন প্রবল প্রতাপে, জলে তার এই শাসন অনেকাংশেই সীমিত। অবশ্য মনুষ্যনির্মিত জঞ্জালের স্তূপ দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ বাদে। প্রকৃতির নিয়মেই পলি জমে সৃষ্টি হয় নতুন দ্বীপের। কিন্তু প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বর্গমাইল আয়তনের দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ পুরোপুরি মনুষ্য নির্মিত। মানবসন্তানদের হঠকারী আচরণের এহেন নিদর্শন বিশ্বে অদ্বিতীয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় দশগুণ আয়তনের মনুষ্য নির্মিত এই জঞ্জালের স্তূপের প্রায় নব্বই ভাগই প্লাস্টিক পণ্য! কত শত বছর এরা সাগর বক্ষে থেকে যাবে, সেটার জবাব নেই কারো কাছেই।
খানিক জিরিয়ে নিতেই শামলাপুরের বাঁকানো সাম্পান নজরে এলো। এদের চোখা প্রান্তগুলো হার মানাবে সদ্য উঠা ইদের চাঁদকেও। তীক্ষ্মতার এ–এক অনন্য প্রদর্শনী। নৌযানের ইঞ্জিনের গুঞ্জন আর বোটের গায়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া বাদ দিলে আশেপাশে নির্বাকতার প্রদর্শনী। কে যেন টুঁিট চেপে ধরেছে বিশাল এই প্রকৃতির। সমুদ্রের জলের সবুজাভ ভাবটা কেটে গিয়ে এদিকে নীলের আধিক্য। অন্যান্য মাছ ধরার নৌকাও কমে গেল সংখ্যায়। বিশাল এই সমুদ্রে আমাদের কাছেপিঠে আপাতত কেউ নেই। কমলা রঙের নৌযান নাগরদোলার দুলুনিতে দুলিয়ে চলছে আমাদের। দিগন্তের মোহ কেটে গেছে নৌকারোহীদের। একটু ডাঙার ছোঁয়া পেতে চায় আমাদের পা দুটো। মনের শ্রান্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেহেও। নৌযান হঠাৎ জলাবর্তে পড়ায় চালকের আসনে বসলেন মুজিব ভাই। দক্ষ হাতে যুঝতে লাগলেন জলভ্রমির সাথে। আমি তখন মনে মনে ‘দরিয়ায় ঘোর তুফান, পার কর নাইয়া’ জপছি। বিপরীত দুটো স্রোতের সংঘাতে তৈরি হওয়া জলের আবর্তকে পাশ কাটিয়ে মুজিব ভাই আমাদের জলযানকে এগিয়ে নিচ্ছেন দক্ষ নাবিকের মতো। জলবিম্ব তুলে একটু একটু করে এগোনো গন্তব্যের পানে।
টেকনাফের পর থেকে তীর আর চোখে পড়ে না। আরণ্যক তটভূমি সেই কবে দূরে সরে গেছে। সঠিক পথে আছি কি না সে ব্যাপারে তাত্ত্বিক কিংবা ব্যবহারিক জ্ঞান নেই আমার। তবে পথে ছেড়ে মাঝে মাঝেই বিপথে যাচ্ছি, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। অবশ্য গুগল ম্যাপ আর আর্থ দেখে পরক্ষণেই বিপথ ছেড়ে পথে ফেরা যায়। এবার সমুদ্রটা প্রকাণ্ড মনে হচ্ছে আরো। পথ ভুলে অল্প কয়েকটা জলকুক্কুট পিছু নিল আমাদের। খাবার দানের উদারতা প্রদর্শন করে গাংচিলের দলের উদর স্ফীত না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ওরা খানিক বাদেই রণে ভঙ্গ দিল। ততক্ষণে সমস্ত চরাচরের উপর পাতলা চাদরের মতো ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার ম্লানিমা। তটভূমিহীন এই সমুদ্র বিশালতার সংজ্ঞাকে আরো একবার মনে করিয়ে দেয়। কান পাতলে বোটের গায়ে ঢেউয়ের ঝাপটা ছাড়াও বাতাসের নিশ্বাসটুকুও শোনা যায়। এই সজল নিশ্বাসে কান পাতার আলাদা একটা আনন্দ আছে। সন্ধ্যা নামার খানিক বাদে ক্ষীণদীপ্তির একটা আলো দেখে গেল সেই সূদুরে। মাঝ সমুদ্রে এই ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে ঐ বিন্দুকে পরম প্রার্থিত আপনজন মনে হচ্ছে। সময় গড়িয়ে চাঁদ উঠতেই ছাড়া ছাড়া অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেল। পূর্ণচন্দ্রের আলোতে এই মাঝসমুদ্রেও দারুণ পথ চলা যাচ্ছে। জলযাত্রার ফাঁকেই আরেক দফা জলযোগ করে নিলাম। জলখাবারের পর চায়ের কাপ পরিষ্কার করার জন্য লাল একটা পাত্রে সাগর থেকে পানি তুলে বোটের আপাত অন্ধকারে আসতেই দেখা পেলাম অনিন্দ্য সুন্দর গ্রিন লুমিনেন্স এর। সেন্ট মারটিন্সে মাঝে মাঝেই ব্লু লুমিনেন্স দেখা যায়। গ্রিন লুমিনেন্স আমার চর্মচক্ষে দেখলাম এই প্রথম। চায়ের পাত্র ধোয়া শিকেয় উঠল। জলনিধির এই জোনাকি দেখলাম মুগ্ধ নয়নে।
রাত ৮টা নাগাদ সেন্ট মার্টিন্সের উত্তর বিচের ঝলমলে আলোর সামনে নিজেদেরকে খানিকটা অসহায় লাগল। গন্তব্যে পৌঁছেও সেটা কেন জানি উপভোগ করা গেল না। অথচ এতক্ষণ যাবত একটু ডাঙার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিল কেবল। সাগরের বুকে প্রবালের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট এটুকু ভূমিকে বড্ড অচেনা লাগল এই তীব্র আলোতে। কোথায় নারিকেল জিঞ্জিরার সেই নারিকেল গাছ কিংবা কেয়াবনের সারি? এখানে সবকিছুই যে পর্যটন নামক চকচকে প্যাকেটে মোড়ানো। দেদার খরচা করতে পারা টুরিস্টদের ছুঁড়ে দেওয়া পয়সার আশায় রিসোর্ট আর রেস্টুরেন্টের পসরা সাজানো দ্বীপজুড়ে। সংরক্ষণের স্বার্থ এখানে পরিত্যাজ্য। সংহারের মচ্ছবে মেতেছে সবাই। পশুধর্মী কিছু লোকের বদিচ্ছার কাছে হার মানতে হচ্ছে গুটিকয় সদিচ্ছাধারীদের। এসব দেখলে নিজেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো মনে হয়। পায়ের নিচে শক্ত মাটির চেনা অনুভূতি ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠল উত্তর সৈকতের এই তিক্ত অনুভূতিটুকু। নবলব্ধ কথাকথিত সমৃদ্ধির তলে চাপা পড়ছে প্রকৃতির অমূল্য ভাণ্ডার। রত্নদ্বীপের চেনা প্রবাল আর নারকেল– কেয়াবনের টানে আসা মানুষের সংখ্যায় আজকাল ভাটার টান। সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঝাঁ চকচকে রিসোর্টের বিচ ভিউ রুমের নাগাল পেতে চাওয়া দোপেয়েদের সংখ্যা ফুলেফেঁপে উঠছে জোয়ারের জলের মতোই। এসব আত্মবিলাপ করতে করতেই এক কোমর জল ডিঙিয়ে পা রাখলাম রত্নদ্বীপ নারিকেল জিঞ্জিরায়।