জলছাপের বাড়ি

শিমু জাকী | বুধবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

আসি আসি শীতে হালকা মোলায়েম ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া হৃদয়টাকে নাড়া দিয়ে যায়। এই সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম বড় একটা কাঠের সিন্দুক থেকে ন্যাপথলিনগন্ধী মোটা কাঁথা আর পাতলা লেপগুলো রোদে শুকিয়ে নিতো। হালকা শীতের রাতে নাক বন্ধ করা সেই কটকটে গন্ধ মাখা মোটা কাঁথাটা মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গা থেকে সরিয়ে রাখতাম। সকালে উঠেই দেখতাম মা আবার কত আদর করে কাঁথা মুড়িয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো।

প্রতিদিন কাঁথালেপ রোদের তাপ জড়িয়ে ভাঁজ করে রাখা হতো রাতে ওমের জন্য। হেমন্তের হিমমাখা শীতের সকালে ছুটির দিনের আলস্যমাখা ঘুমের পর চোখ খুলতাম সূর্যের চিক চিক মিঠে আলোর নরম আদরে।

সকালের নরম রোদ পোহানো, নিভিয়া, তিব্বত পমেডের ঘ্রাণ যেনো এখনো হাতে পায়ে লেগে আছে। মায়ের আলাদা একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধ, মায়াময় গন্ধ পেতাম । এই গন্ধ মনে হয় মায়েদের গা থেকেই পাওয়া যায়।

আমার সন্তানদের শোনাই খেঁজুরের কাঁচা রসের গল্প, মাটির চুলোয় বাঁশ পুড়িয়ে বানানো ভাপা পিঠার গল্প, মায়ের হাতে নতুন গুড়ের অমৃত পায়েশের গল্প। আর চোখ বন্ধ করে মা কে ছুঁই।

গাঁয়ের বুকে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যখন বয়ে যেতো, রান্নাঘরে খেঁজুরের রসের জ্বাল দেওয়া সুঘ্রাণে মৌ মৌ করতো অনেক দূর অবধি। রসের বলক উপচে না পড়তে খেঁজুরের পাতা চুবিয়ে রাখা হতো ডেকচিতে। চুলার কাছে গিয়ে সেই রসের ভাঁপে ঘ্রাণ নিতাম। গরম গরম দুধ চিতৈ, রসে ডুবানো টইটুম্বুর নারকেল পিঠা, নতুন চালের পায়েসসেই স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে এখনো।

বাড়িতে নতুন চালের ভাপা পিঠা বানানোর আমেজটা ছিলো চমৎকার। নতুন চাল ধুয়ে রোদে হালকা শুকিয়ে ঢেঁকিতে বানানো হতো পিঠার গুড়া। সন্ধ্যা থেকে ঢেঁকির আওয়াজে মুখরিত থাকতো রান্নাঘর। নতুন বিন্নি চালের ভাত, ঝাল ঝাল রান্না করা হতো গরু, মুরগি আর থাকতো খেঁজুরের রাপ। বড় বড় চালুনীতে ভাপা পিঠার স্তুপ।

শিশির ভেজা শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা দেখতাম, দল বেঁধে বকুল ফুল কুড়ানো, ফ্রকের খাপে করে ভরে আনতাম সব ফুল, আর মালা গেঁথে ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখতাম। আর কিছু বইয়ের পাতার ভাজে চাপা দিয়ে রাখতাম।

বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে পুরো মাসটাই ছিল আমাদের জন্য ঈদ আনন্দের। স্কুল মাঠে টকি সিনেমা নিয়ে আসতো পাড়ার বড়রা, বানানো হতো মঞ্চ নাটক। পাড়ার বড় ভাইরা নাটক করতো। কুয়াশায় ঢেকে থাকা রাতের বেলায় শীতে গুটিয়ে গাটিয়ে সোয়েটার আর মাফলার পেঁচিয়ে বসে থাকতাম নাটক দেখতে। আমাদের জন্য প্রথম সারিতে রাখা হতো আরামদায়ক আসন। শীতের ঠাণ্ডা এক ঝলক হাওয়া এসে কান ছুঁয়ে দিত। কাঁপুনি শীতকে উপেক্ষা করে গায়ের কালো শালটাকে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিতাম। উৎসুক ঘুমহারা চোখদুটো ছানা বড়া হয়ে থাকতো টকি সিনেমার পর্দায়।

শসা ক্ষেতে গিয়ে কচি শসা ছিঁড়ে খাওয়া, একটাকা দামের ঝুরা আচার ভাগাভাগি করে খাওয়া, কাচের বোতলের বিনিময়ে কটকটি কিনে খাওয়া, সন্ধ্যা নামলে কাচারী ঘরে হারিকেনের আলোয় সবাই একসাথে পড়তে বসা, ভোর হলে দল বেঁধে হুজুরের মক্তবে আরবী পড়া, দুরুদুরু বুকে সুরা পাঠ করা আরো কত কত স্মৃতি।

আহা, এমন কত কত স্মৃতি ফেলে এসেছি! আমার ছিল একটা নিশ্চিন্ত নির্ভার জীবন, সাবলীল সহজ জীবনটা হারিয়ে গেল তবুও আমি ওখানে যাই। ওখানে আমার মায়ের গন্ধ লেগে আছে। আসলে জীবন একটা এলবাম, প্রতিটি পাতায় স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াই। নিজের মাঝে জিঁইয়ে থাকা শৈশবটাকে সন্তানদের মাঝে জমা রাখতে চাই।

বাড়িটাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে এই অবেলায়। চলমান সভ্যতার আড়ালে হারিয়ে গেল আমার বাড়ি, আমার মা আর আমার বাবাটা। যেখানে বাবা মাকে মনে করতাম আমার আকাশ। আর আমার আয়ত্বটাকে মনে করতাম পৃথিবী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুদের নিরাপত্তার খাতিরে দখলমুক্ত ফুটপাত চাই
পরবর্তী নিবন্ধস্বৈরাচারের পতন!