২য় পর্ব
২য় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৮ সালের দিকে মূলত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় বাজেট অসংকুলানের কারণে ইতালিতে ‘নিও রিয়ালিজম’ চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে লাজুয়াদা, ডি সিকা, জারমি, রোজেলিনি, ভিসকন্তি, জাভাত্তিনি প্রমুখের নেতৃত্বে। ফেলিনিও এই আন্দোলনের মূল তরঙ্গে ছিলেন উল্লেখিত পরিচালকদের সঙ্গে সহকারী চিত্রনাট্যকার ও সহকারী হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে। ১৯৫০ সালে ফেলিনি আলবার্তো লাতুয়াদার সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন ‘লুসি দেল ভেরিয়েতা।’
১৯৫২ সালে স্বতন্ত্র পরিচালকরূপে ফেদেরিকো ফেলিনির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘লো সিকো বিয়ানকো’ (দি হোয়াইট শেখ) তৈরি করলেন নিজের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে। প্রথম ছবিতেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হলেন। এরপর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে লাগলেন। ১৯৫৪ সালে বিশ্ব চলচ্চিত্রকে উপহার দিলেন তাঁর অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘লা স্ত্রাদা’ (The street)। এটি তাঁর চতুর্থ চলচ্চিত্র। মানবিক গুণসমৃদ্ধ এই চলচ্চিত্র ফেলিনিকে যেমন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করলো, তেমনি একই সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী জুলিয়েতা মাসানিকে এনে দিল তারকা খ্যাতি। জুলিয়েতার বিপরীতে এ-ছবিতে অভিনয় করেন আরেক কিংবদন্তি এন্থনি কুইন। কিন্তুু নিও রিয়ালিজম আন্দোলনের মুখ্য তাত্ত্বিক জাভাত্তিনি ফেলিনিকে লা স্ত্রাদায় নিও রিয়ালিজম ধারার রীতিনীতি বিসর্জনের অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন। প্রত্যুত্তরে ফেলিনি তৈরি করলেন ‘ইল রিদোনে’ ১৯৫৫ সালে। এই ছবিতে তিনি তাঁর মতে নিও রিয়ালিজমের অতি নাটকীয় এবং আবেগাবিষ্ট দিকগুলোকে আক্রমণ ও বর্জন করলেন।
ক্রমাগত খ্যাতি আর সাফল্য তাঁকে এবার এনে দিল বিশাল বাজেটের ছবি করার সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৯৬০ সালে ফেলিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রকে উপহার দিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘লা দোলচে ভিতা’ (The Beautiful life)। এই ছবি বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি ফেলিনির প্রতিনিধিত্বশীল চলচ্চিত্র হয়ে উঠলো। ফেলিনিকে চলচ্চিত্রবিশ্বে করে তুললো অপরিহার্য। লা দোলচে ভিতার পর ফেলিনি তৈরি করলেন তাঁর আরেক অবিস্মরণীয় চিত্রকৃতি ‘অটোই মেজ্জো’ (Eight and Half) । এই ছবি ফেলিনিকে খ্যাতির চরম শিখরে তুলে দিল।
ফেলিনি এবার তাঁর আঙ্গিকে আনলেন একটু ভিন্নতা। কৌতুকাবহের পাশাপাশি যোগ করলেন রূপকধর্মিতা যাকে সমালোচকেরা আখ্যায়িত করলেন ‘ফেলিনি ফ্যান্টাসি’ অভিধায়। এ-ধারায় তৈরি করলেন ‘জুলিয়েতা দেগলি স্পিরিতি’ (Julite of the sprit) ১৯৭২ সালে রোসের জটিল নাগরিকতা নিয়ে তৈরি করলেন তাঁর আরেকটি স্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘রোমা’। জন্মস্থান রিসিনিতে কাটানো শৈশব আর যৌবনের স্মৃতি নিয়ে ১৯৭৪ সালে ফেলিনি নির্মাণ করলেন তাঁর আর একটি সেরা চলচ্চিত্র ‘অ্যামারকর্ড’।
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেলিনির ছবিগুলি মূলত আত্মজৈবনিক। নিজের জীবনের কথাই ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে। তাই বলে সীমাবদ্ধ থাকেননি এক জায়গায়। গড়েছেন আর ভেঙেছেন ক্রমাগত নিজেকে। বিবর্তন ঘটিয়েছেন নিজের রীতিনীতিতে, বিষয় বৈচিত্র্যে, যা তাঁর প্রগতিশীলতাকে প্রকাশ করে। পাঁচবার অস্কার বিজয়ী (লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট-এর বিশেষ অস্কার ছাড়া বাকি চারটি পান লা স্ত্রাদা, লে নোত্তি ডি ক্যারিবিয়া, অট্টোই মেজ্জো এবং অ্যামারকর্ড-এর জন্য) এই মহাশিল্পী নিজের বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বিচিত্রতাকে বারবার তাঁর চলচ্চিত্রের উপাদান করে তুলেছেন। একের পর এক আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে নিজস্ব ধ্যান ধারণা চাপিয়ে দেয়া, ব্যক্তিগত সংস্কারকে চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করা ইত্যাকার অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত করার পরেও সমালোচকেরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন ফেলিনির এসব প্রয়োগকে, তাঁর সহজাত ও স্বচ্ছন্দ কৌতুক আর রূপক শৈলীর কারণে যাকে ফেলিনি ঘরনার বলেও আখ্যায়িত করেছেন তাঁরা। আর বিশ্ব চলচ্চিত্রে এই মৌলিক ঘরানার কারণেই ফেদেরিকো ফেলিনি অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবেন শ্রেষ্ঠ একজন রূপকারের মহিমায়। শতবর্ষে এই মহাশিল্পীকে সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাঞ্জলি।