জনহয়রানি রোধে রাষ্ট্র মেরামত জরুরি

এস এম ফরিদুল আলম | শনিবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

শ্রদ্ধাভাজন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের গর্ব। চট্টগ্রাম থেকে কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হয়নি। একমাত্র প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদ মর্যদায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হলেন। ছাত্রজনতার চাপে ও সেনা প্রধানের অনুরোধে রাষ্ট্রপতি তাঁকে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা কায়মনোবাক্যে তাঁর চূড়ান্ত সাফল্য, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ছাত্রজনতার তুমুল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। তবে যাদের শাহাদাতের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের জন্ম তাদের আমরা কখনো ভুলব না। ইতিহাসের গৌরবময় বিপ্লবের জন্য শত শত ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমরা প্রতিটি মুহূর্তে এই বিপ্লবে শাহাদাত বরণকারী সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং শত সহস্র প্রাণঘাতি আঘাতের শিকার হয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন, কিংবা চক্ষু হারিয়েছেন তাঁদের প্রতি অভিবাদন। গত সাড়ে ১৫ বছরে স্বৈরাচারী সরকারের নজর বেশি ছিল অবকাঠামোগত উন্নয়নে। মেঘাপ্রকল্পের নামে বিদেশী ঋণ নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। প্রকল্প শেষ হলেও লাভ তো দূরের কথা, বিনিয়োগ তুলে আনাও বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এ প্রকল্পগুলো প্রয়োজনে হোক আর অপ্রয়োজনে হোক বিনিয়োগ যেহেতু হয়ে গেছে এখন সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি শক্ত হাতে দমন করতে পারলেই বিনিয়োগ তুলে আনা সম্ভব। তবে স্বদেশের সুশাসন নিশ্চিতকরণে স্বাধীনতাত্তোর ৫৫ বছরে কোনো সরকারই চেষ্ট করেনি। তবে কেয়ারটেকার সরকারের সময় কিন্তু নিরীহদের জন্য সুশাসন স্থিতিশীল থাকে মাত্র। পরবর্তীতে নির্বাচনোত্তর ক্ষমতাসীন হলে তারাই দুর্নীতির সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করে নিজেরা আখের গুছিয়ে সদলবলে অর্থবিত্ত কালো টাকার মালিক বনে যায়। যতবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ততবারই নতুনভাবেই ক্ষমতাসীনরা কোটি কোটি টাকা ও অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছে। ক্ষমতাসীনগণ বিদেশে সেকেন্ড হোম বানিয়েছে এবং সুইচব্যাংক ও অন্যান্য অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে। বিদেশে টাকা পাচার করে কালো টাকার পাহাড় গড়েছে। নিরীহ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অষ্ট্রেলিয়ায় বড় ছেলের সুবাদে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি সেখানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত। অন্যায় দুর্নীতি করে কেউ পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আইন সবার জন্য সমান এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ আছে সর্বত্রই। বরং আমাদের দেশে আইনের অপপ্রয়োগ সর্বত্রই লক্ষ্য করা গেছে এবং নিরীহ জনগণ তার শিকার। অষ্ট্রেলিয়ায় ফেডারেল সরকার, দেখা গেছে জনগণই প্রকৃত ক্ষমতার মালিক এবং প্রকৃত ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাসীন হন এবং প্রত্যেক নাগরিকের সর্বত্রই সর্বোচ্চ সম্মান ও সমান অধিকার এবং ন্যায় বিচার ও আইনের অনুশাসন সবাইকে মেনে চলতে বাধ্য। কোনো ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় ও অনিয়ম চোখে পড়েনি। বিদ্যমান রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাতের কাজ কত টেকসই না দেখলে বুঝবেন না। ওখানে ঐ সমস্ত কাজগুলো করে ১০০ বছরের পরিকল্পনা করে। আর আমাদের দেশের শহরগুলোতে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ড্রেন ভাঙে ও মেরামত করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করে। কোনো জবাবদিহিতা নেই। সব সময় হরিলুট চলে। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনদের কালো টাকার মালিকদের চেহারা দেখে বিচারকেরা মামলা মোকাদ্দমা রায় ডিগ্রি, জামিন দেন। বলতে গেলে নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হলে পুলিশ, বিচারবিভাগ, প্রশাসন থেকে সববিভাগই তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এক কথায় দুর্নীতির মহোৎসব চলে। দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে এবং আজকের কাজ আজই করুন মর্মে সর্বত্রই অফিসাদেশ জারি করে সমাজের নিরীহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জনহয়রানি রোধে দুর্নীতিকে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা জনস্বার্থে অপরিহার্য। এখন বসন্তের কোকিলেরা নির্বাচন দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে করে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর কেউ সত্যিকারভাবে টু শব্দ করতে পারেনি। ছাত্রজনতা জীবন দিয়ে ৫ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। শুধুমাত্র বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনার সরকারকে ক্ষমতাসীন করেছে এবং ন্যায়ের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সুতরাং রাজনীতির নামে দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতাসীন হয়ে সব রাজনৈতিক দলই ধরাকে সরাজ্ঞান করেছে। তাই রাষ্ট্র মেরামতের মনুষ্য বসবাসের মত সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করে যৌক্তিক সময়ে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং দুর্নীতি, কালো টাকা, পেশি শক্তি, ঘুষ, খুন, গুম, দখল, বেদখল, জাল জালিয়াত, স্বজনপ্রীতি অন্যায় অনিয়মকে নির্বাসনে দিতে হবে।

রাষ্ট্র মেরামতের সুযোগটা সৃষ্টি হলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ত্যাগের ফসল। কাজটা খুবই চ্যালেঞ্জিং বটে তবু ও দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বৃটিশ উপনিবেশকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের দাবি এসেছে। ১৯০৯, ১৯৩৫, ১৯৯৯, সালের ভারত শাসন আইনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ ভারত নামে উপনিবেশ রাষ্ট্রকে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্রও রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতাত্তোর সংবিধান প্রণয়ন, জিয়া ও এরশাদের আমলে বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্কার ও রাষ্ট্র সংস্কার/মেরামতের উদ্যোগ নিলেও কোনোটিই জনসমর্থিত ছিল না। ১৯৯০ এর গণ আন্দোলন, পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের ঘোষণায় ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে সীমিত পর্যায়ে রাষ্ট্র মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ২০০৭২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ, পাকিস্তান এবং স্বাধীনতাত্তোর পরবর্তী সংস্কারগুলো কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা রক্ষায় বৈষম্যহীন ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থী আন্দোলন ২০২৪ টি প্রকৃত স্বাধীনতা বলে জাতি আনন্দ উল্লাস করছেন। তারুণ্যের কণ্ঠে যে সংস্কারের কথা শুনা যাচ্ছে, তা হলো ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক প্রশাসনিক বিচার বিভাগীয় সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক সংস্কারের বৃহত্তর পরিসরে উত্থাপিত। যার লক্ষ্য এক মানবিক, সমতাভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজও রাষ্ট্র নির্মাণ।

যে নৈতিকতার ধস নেমেছে তা পুনরুদ্ধার করে দেশের ল এন্ড অর্ডার এর যথাযথ প্রয়োগ কোথাও আইনের অপপ্রয়োগ নয় মর্মে দেশ পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে যথাযথ নির্দেশনা আন্তরিকভাবে পালনে বাধ্য করতে হবে। ঘুষ নামক মারাত্মক ব্যাধি প্রবর্তন শূন্যের কোটায় আনতে হবে। মানুষকে সৎ রোজগারে উদ্বুদ্ধ করার সৎপথে জীবন ধারণ পদ্ধতিতে পরিবার পরিচালনায় বাধ্য করতে হবে। ঔপনিবেশিক আমলের আইন, কানুন ও স্বৈরাচারের তৈরীকৃত নিবর্তন, নির্যাতন, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানুষের মৌলিক ন্যায্য দাবি ও অধিকার হরণের মত যাবতীয় হয়রানিমূলক আইনের অপশাসন থেকে আপামর জনতাকে বাঁচাতে হবে। দেখা গেছে অতীতের সব দলই নিজেদের পারিবারিক তন্ত্র ও দলীয় তন্ত্রের আবরণে তাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে চলে বলে নানান অপকৌশলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, খুন খারাবী, রাহাজানি, নানান অপকর্ম করে আমলাদের ব্যবহার করে কালো টাকা বানাতে সদা ব্যস্ত থাকে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নমিনেশন বাণিজ্য নানান দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। আপামর জনগণের কল্যাণে এদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। লক্ষ্য করা যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজ মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে এদেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৪ সপ্তাহ যেতে না যেতেই রাজনৈতিক দল নামক সংগঠনগুলো দল গুছিয়ে অতীতের ন্যায় নির্বাচনের দিবা স্বপ্নে বিভোর হয়ে পুনঃক্ষমতাসীন হয়ে অতীতের ন্যায় নানান অপকর্ম করে দেশের জনগণকে পুনরায় মনুষ্যসৃষ্টি দোজখে ঠেলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। অভিজ্ঞ মহল বলছে সম্ভব হলে দীর্ঘদিনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের অপতৎপরতা নিষিদ্ধ করে স্বদেশে ভালো মানুষ বসবাস উপযোগী করে সুষ্ঠু একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা তৎজন্য প্রবীণদের পক্ষ থেকে এ সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছি।

লেখক : কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধওয়াল্টার স্কট : কবি ও ঔপন্যাসিক
পরবর্তী নিবন্ধওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নেপথ্যে ইতিহাস