জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি রোধ করতে হবে

| সোমবার , ৭ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে ঘরে ঘরে জ্বর, কাশি, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে মানুষ ভুগছে। কোভিডের মতো মহামারি আখ্যায়িত করা না হলেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। তা কোভিড থেকে কোনো অংশে কম নয়। দু’তিন দিন জ্বর থাকলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হচ্ছে। যাদের ডেঙ্গু নেগেটিভ হচ্ছে তাদের কিন্তু জ্বর ছাড়ছে না; সঙ্গে লেগে থাকে কাশিও। কারও কারও ক্ষেত্রে রক্তের প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যায়। ডেঙ্গু নয় জেনে স্বস্তি পেলেও এই জ্বরের কারণ এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে তো ভোগান্তির অন্ত নেই। হাসপাতালেও এখন জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৩০০ অতিক্রম করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যদিও ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত অক্টোবর মাসেই ডেঙ্গুর মৌসুম বা পিক সিজন বলে ধরা হয়। তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবেশের প্রভাব অত্যধিক; কিন্তু এই পরিবেশগত উন্নয়নকে আমরা তেমন তোয়াক্কা করছি না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটের পাশাপাশি হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, আবাসিক এলাকা, পার্ক প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি সর্বদা পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে জনগণের সচেতনতার অভাবও বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, তাঁরা ময়লাআবর্জনা ফেলে ভাগাড় তৈরি করলেও তা পরিচ্ছন্ন রাখবার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে সরকারের। আরও স্পষ্ট করে বললে স্থানীয় সরকারের। স্থানীয় সরকারগুলি তাদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করবে নিশ্চয়ই; কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে এই কাজ হবে কঠিন ও জটিলতর। তাঁরা বলেন, আসলে স্বাস্থ্যের উপর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ থেকেই সংক্রামক ব্যাধি তথা রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। দূষিত পানি, দূষিত বায়ু, পচাবাসি খাবার, উন্মুক্ত জায়গায় ও অস্বাস্থ্যকরভাবে প্রস্তুত খাবার গ্রহণ, আবর্জনা ও মলমূত্র নিষ্কাশন অব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, স্যাঁতস্যাঁতে বাসস্থান ও কর্মস্থল ইত্যাদি রোগ বিস্তারে সহায়তা ও স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করে। বিশুদ্ধ পানি, মুক্ত বাতাস, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, আলো ও বাতাসময় পরিবেশ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর সুষম খাদ্য ইত্যাদি সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। এই সকল জ্ঞান সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সম্যক ধারণা থাকা দরকার।

নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সভানত্রেী ফরিদা আখতার তাঁর এক লেখায় বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, এটা আমরা জানি। একই সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্য নানা রকম ঝুঁকির সৃষ্টি হয়জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করেন। কিন্তু এ বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এল নিনোর প্রভাব এবং এর সঙ্গে ভেক্টরবাহিত রোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এল নিনোর মতো পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, এমন গবেষণা হয়নি। এখানে মশার চরিত্র বদলাচ্ছে কিনা; এডিস মশা দিনে কামড়ালে ডেঙ্গু হয় নাকি রাতে; এডিসের লার্ভা কি স্বচ্ছ পানিতে হয় নাকি এখন ময়লা পানিতেও পাওয়া যাচ্ছেএ নিয়ে সিটি করপোরেশনের চিন্তার অন্ত নেই। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান দিয়ে এবং হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। রোগতত্ত্ব বিভাগও তাপমাত্রার সঙ্গে ডেঙ্গুর সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে তথ্য দেয়নি। সিটি করপোরেশন বিভিন্ন এলাকায় মশার লার্ভা পাওয়া যায় কিনা অভিযান চালিয়ে এবং জরিমানা করেই খালাস। মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মশার প্রজননও বেড়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে সবকিছুকে খণ্ড খণ্ডভাবে দেখার প্রবণতা দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়া দপ্তরের বিষয়। এর সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটা অস্বীকার করা যায় না বলে ফসলের ক্ষতির কথা আসে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে তাপমাত্রার এই উর্ধ্বগতির সঙ্গে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে; উন্নয়নের কাজগুলো পরিবেশসম্মত হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য সমস্যায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত। কোভিডের মতো ডেঙ্গুও ধনীগরিব বাছবিচার করে না। শুধু পার্থক্য এই; ধনীর মশারি আছে, গরিবের নেই। হাসপাতালে এখন আহাজারি।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর টিকা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। এতে আমরা আশান্বিত হতে পারি। তবে এর পরও পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা অর্জন, স্বাস্থ্যশিক্ষার বিস্তার ও সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি রোধ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে